পুণার অবস্থা
আজ পুণা শহর বম্বে প্রদেশের দ্বিতীয় রাজধানী, মারাঠাদের শিক্ষা সভ্যতা ও আকাঙ্ক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। কিন্তু ১৬৩৭ সালে যখন বালক শিবাজী এখানে বাস করিতে আসিলেন, তখন পুণা একটি গণ্ডগ্রাম—অতি শোচনীয় দশায় উপস্থিত। ছয় বৎসর ধরিয়া যুদ্ধে দেশ ছারখার হইয়া গিয়াছিল, বার বার নানা আক্রমণকারী আসিয়া গ্রাম লুঠ করিয়া পুড়াইয়া দিয়া চলিয়া যাইত, তাহার পর অরাজকতার সুযোগে আশপাশের ডাকাত-সর্দ্দারেরা নিজ আধিপত্য স্থাপন করিত। অঞ্চলটি ভূতের লীলাক্ষেত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।
মানুষের মধ্যে যুদ্ধ, অশান্তি ও লোকক্ষয়ের ফলে পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলে নেকড়ে-বাঘের বংশ খুব বাড়িয়া গিয়াছিল; তাহাদের উৎপাতে পুণা জেলার গ্রামগুলিতে ভেড়া বাছুর এবং ছেলেপিলে নিরাপদ ছিল না; ভয়ে চাষবাস প্রায় বন্ধ হইল।
দাদাজী কোণ্ডদেব, অভিভাবক
১৬৩৭ সালে, শাহজী বিজাপুরের চাকরি লইয়া মহীশূর প্রদেশে চলিয়া যাইবার সময় দাদাজী কোণ্ডদেব নামক এক বিচক্ষণ সচ্চরিত্র ব্রাহ্মণকে পুণা জাগীরের কার্য্যকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া তাঁহাকে বলিলেন, “আমার প্রথম স্ত্রী ও পুত্র শিবাজী শিবনের দুর্গে আছে। তাহাদের পুণায় আনিয়া রক্ষণাবেক্ষণ কর।” তাহাই করা হইল।(৩)
এই পুণা জাগীরের খাজনা কাগজে চল্লিশ হাজার হোণ (অর্থাৎ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা) ছিল, কিন্তু আদায় হইত অনেক কম। দাদাজী কোণ্ডদেব জমিদারী কাজে সুপরিপক্ক। তিনি সহ্যাদ্রি শ্রেণীর পাহাড়ী লোকদিগকে পুরস্কার দিয়া সেখানকার নেকড়ের দল নির্ব্বংশ করিলেন; ঐ লোকদের হাত করিয়া প্রথমে জমির খাজনা খুব কম, পরে ধীরে ধীরে বর্দ্ধনশীল নিরিখে ধার্য্য করিয়া, তাহাদিগকে সমতল ভূমিতে আসিতে ও চাষ করিতে রাজি করাইলেন। এইরূপে দেশে লোকের বসতি ও কৃষিকার্য্য দ্রুত বাড়িতে লাগিল।
শান্তিরক্ষার জন্য তিনি কতকগুলি স্থানীয় সৈন্য,অর্থাৎ বর্ক-আন্দাজ, নিযুক্ত করিয়া জায়গায় জায়গায় থানা বসাইলেন। দাদাজীর দৃঢ়শাসন ও ন্যায় বিচারে দস্যু ও অত্যাচারীর নাম পর্য্যন্ত দেশ হইতে লোপ পাইল। তাঁহার নিয়মপালনের একটি গল্প আছে। তিনি “শাহজী বাগ” নাম দিয়া একটি ফলের বাগান করেন। তাঁহার কড়া আদেশ ছিল, কেহ গাছের পাতাটি পর্য্যন্ত লইলে শাস্তি পাইবে। একদিন ভুলিয়া তিনি নিজেই একটি আম পাড়িলেন। নিয়মের কথা মনে পড়িলে নিজের উপর দণ্ড দিবার জন্য তিনি অপরাধী নিজ হাত কাটিয়া ফেলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময় সকলে ধরিয়া তাঁহাকে থামাইল। ইহার পর হইতে তিনি অপরাধের চিহ্নস্বরূপ একটি লোহার শিকল গলায় পরিয়া থাকিতেন।
শিবাজী লিখিতে পড়িতে জানিতেন না, কিন্তু তাহাতে তাঁহার ক্ষতি হয় নাই। আকবর, হাইদার আলী, রণজিৎ সিংহ—ভারতের এই তিনজন কর্ম্মীশ্রেষ্ঠ রাজাও নিরক্ষর ছিলেন। সে সময়টা মধ্যযুগ, অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত; তখনকার দিনে এই পুঁথিগত বিদ্যার অভাব তাঁহার মনকে অন্ধকার অকর্মণ্য করিয়া রাখে নাই, অথবা তাঁহার কার্য্যদক্ষতা হ্রাস করে নাই। কারণ, শিবাজী রামায়ণ মহাভারতের গল্প এবং পুরাণ-পাঠ ও কীর্ত্তন শুনিয়া শুনিয়া প্রাচীন ভারতের জ্ঞান ধর্ম্ম কত কাব্য-কাহিনীর আস্বাদ পান, রাজনীতি, ধর্ম্মনীতি, রণকৌশল ও শাসন-বিধান শেখেন। যেখানে কীর্ত্তন হইত সেখানে তিনি যাইতেন এবং তন্ময় হইয়া শুনিতেন; কোন হিন্দু-সন্ন্যাসী বা মুসলমান পীরের আগমন হইলে তিনি তাঁহার কাছে গিয়া ভক্তি দেখাইতেন এবং ধর্ম্মের উপদেশ লইতেন। কাজেই শিক্ষার প্রকৃত ফল তাঁহাতে সম্পূর্ণভাবে ফলিয়াছিল।
মাব্লে জাতি
পুণা জেলার পশ্চিম প্রান্তে সহ্যাদ্রি পর্ব্বতের গা বাহিয়া ৯০ মাইল লম্বা এবং ১২ হইতে ২৪ মাইল প্রশস্ত যে ভূমিখণ্ড আছে, তাহার নাম ‘মালব’(৪) অর্থাৎ সুর্য্যাস্তের দেশ বা পশ্চিম। এই অঞ্চলটি অত্যন্ত অসমান, অধিত্যকার পর অধিত্যকা, আর তাহাদের ধারগুলি খাড়া হইয়া নামিয়াছে; নীচে আঁকা-বাঁকা গভীর উপত্যকা। এই নীচের সমভূমি হইতে ছোট-বড় অনেক পাহাড় স্তরে স্তরে উঠিয়াছে, তাহাদের উঁচু গায়ে কাল কষ্টিপাথরের বড় বড় বোল্ডার্ ছড়ান। স্থানে স্থানে পর্ব্বত-গাত্র বনে আবৃত, গাছের তলায় ঘন গাছড়া ও লতাপাতা চলিবার পথ বন্ধ করিয়াছে।
এই মাব্ল প্রদেশের উত্তরাংশে কোলী নামক এক প্রাচীন অসভ্য দস্যুজাতির বাস, আর দক্ষিণাংশে মারাঠা কৃষক। মাব্লের মারাঠাদের শরীরে কিছু পাহাড়ী জাতির রক্ত মিশ্রিত আছে; তাহাদের আকৃতি কাল সরু, কিন্তু মাংসপেশী—বহুল ও কর্ম্মঠ। এদেশের বাতাস শুষ্ক ও হালকা, এবং দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য স্থান হইতে কম গরম। মাব্লের জলবায়ু শরীরে বল বৃদ্ধি করে।
শিবাজীর মাব্লে বন্ধুগণ
দাদাজী মাব্লদেশ নিজের অধীনে আনিলেন। অনেকে গ্রামের তহসিলদার (দেশপাণ্ডে)-কে হাত করিলেন। যাহারা অবাধ্য হইল তাহাদের যুদ্ধে বিনাশ করিলেন। এইরূপে সেই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থাপিত হইল এবং মাব্ল গ্রামগুলি পুণা জেলার অধিকারীর পক্ষে অর্থ ও লোকবলের কারণ হইয়া দাঁড়াইল। এই মাব্ল দেশ হইতে শিবাজীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পদাতিক সৈন্য আসিল; এখানে তাঁহার বাল্যবন্ধু ও অত্যন্ত অনুগত কর্ম্মচারিগণ পাওয়া গিয়াছিল। ইহাদের সঙ্গে বালক শিবাজী পশ্চিমঘাটের বন-জঙ্গল ও পর্ব্বতে, নদীতীরে ও উপত্যকায় ঘুরিয়া বেড়াইতেন। তিনি ক্রমেই কষ্টসহিষ্ণু ও অক্লান্তশ্রমী হইয়া উঠিলেন এবং দেশ ও দেশবাসীদের বিশেষ ঘনিষ্ঠভাবে চিনিলেন। শিবাজীর উত্থানে মাব্ল-জমিদার ও বলিষ্ঠ কৃষকদের পক্ষে সমস্ত দাক্ষিণাত্য ব্যাপিয়া কার্য্যক্ষেত্রের পরিসর বাড়িয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে অর্থ ক্ষমতা ও খ্যাতিলাভের মহাসুযোগ জুটিল। শিবাজীর যুদ্ধ ও লুণ্ঠনে সহকারী হইয়াই এই কোণঠাসা গরীব গ্রাম্যলোকেরা সেনাপতি ও সম্রান্ত পুরুষের পদে উঠিতে পারিল। সুতরাং তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁহার রাজ্যাভিলাষের সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা হইল। তিনি খোলাখুলি ভাবে মিশিয়া তাহাদের ভাইবন্ধুর সামিল হইলেন। ফরাসী-সৈন্যদের চক্ষে নেপোলিয়ন যেমন একাধারে বন্ধু নেতা ও দেবতার সমান ছিলেন, মাব্লদের নিকট শিবাজীও তাহাই হইলেন।