রাজস্ব ও ধনভাণ্ডার শিবাজীর সভাসদ কৃষ্ণাজী অনন্ত ১৬৯৪ সালে লিখিয়াছেন যে, তাঁহার প্রভু রাজস্বের পরিমাণ বৎসরে এক কোটি হোণ এবং চৌথ আশী লক্ষ হোণ ধার্য ছিল। হোণ একটি খুব ছোট স্বর্ণমুদ্রা, ইহার দাম প্রথমে চারি টাকা ছিল, পরে পাঁচ টাকা হয়; সুতরাং এই দুই বাবদে শিবাজীর আয় সাত হইতে নয় কোটি টাকার মধ্যে ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদায় হইত অনেক কম, এবং তাহাও সব বৎসরে সমান নহে। তাঁহাব মৃতুর পর তাঁহার ভাণ্ডারে যে ধনরত্ন পাওয়া যায় তাহার পরিমাণ মারাঠা ভাষার সভাসদ-বখরে এবং ফারসী ইতিহাস “তারিখ-ই-শিবাজী”তে বিস্তারিতভাবে দেওয়া আছে। ইহার মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা ছিল ছয় লক্ষ মোহর এবং প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ হোণ, ও সাড়ে বারো খণ্ডী। ওজনের ভাঙ্গা সোনা; রৌপ্যমুদ্রা ছিল ৫৭ লক্ষ টাকা, এবং ৫০ খণ্ডী। ওজনের ভাঙ্গা রূপা; এ ছাড়া হীরা মণিমুক্তা বহু লক্ষ টাকা দামের। (এক খণ্ডী কলিকাতার সাত মণের কিছু কম, ৬৮ মণ]
অষ্টপ্রধান
১৬৭৪ সালে রাজাভিষকের সময় শিবাজীর আটজন মন্ত্রী ছিলেন; সেই উপলক্ষে তাঁহাদের পদের উপাধি ফারসী হইতে সংস্কৃতে বদলান হয়ঃঃ-
(১) মুখ্যপ্রধান (ফারসী নাম, পেশোয়া); ইনিই প্রধান মন্ত্রী, রাজার প্রতিনিধি ও দক্ষিণ হস্ত-স্বরূপ; নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে মতভেদ হইলে ইনি তাহার নিষ্পত্তি করিয়া রাজকার্য্যের সুবিধা করিয়া দিতেন। কিন্তু অপর সাত প্রধান তার অধীন বা অজ্ঞাবহ ছিল না, সকলেই নিজ নিজ বিভাগে একমাত্র রাজা ভিন্ন আর কাহাকেও প্রভু বলিয়া মানিত না। (২) অমাত্য (ফারসী, মজমুয়া-দার) অর্থাৎ হিসাব-পরীক্ষক (অডিটর বা একাউন্ট্যান্ট-জেনারেল); তাহার স্বাক্ষর ভিন্ন রাজ্যের আয়ব্যয়ের হিসাবে কাগজ গ্রাহ্য হইত না।
(৩) মন্ত্রী (ফারসী, ওয়াকিয়া-নবিশ); ইনি রাজার দৈনিক কার্য্যকলাপ এবং দববারের ঘটনার বিবরণ লিখিতেন। যাহাতে রাজাকে গোপনে হত্যা বা বিষ খাওয়াইবার কোনরূপ চেষ্টা না হয়, সেজন্য রাঙ্গাব সঙ্গী, দর্শনপ্রার্থী আগন্তুক ও খাদ্যদ্রব্যের উপর মন্ত্রীকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে হইত।
(৪) সচিব (ফাবসী, শুরু-নবিস); ইনি সবকারী চিঠিপত্রের ভাষা ঠিক হইল কিনা দেখিয়া দিনে। যাতে জাল রাজপত্রের সৃষ্টি না হয়, সেইজন্য সচিবকে প্রত্যেক ফর্মান ও দানপত্রের প্রথম পংক্তি নিজহস্তে লিখিয়া দিতে হইত।
(৫) সুমন্ত (ফারসী, দবীর) অর্থাৎ পর-রাজ্য-সচিব (ফরেন সেক্রেটারী); ইনি বিদেশী দূতদের অভর্থনা ও বিদায় করিতেন এবং চরের সাহায্যে অন্যান্য রাজ্যের খবর আনাইতেন।
(৬) সেনাপতি (ফারসী, সরু ই-নৌবৎ)
(৭) দানাধ্যক্ষ, অথবা মারাঠী ভাষায় ডাক-নাম “পণ্ডিতরাও”(ফারসী, সদব ও মুহতসিবের পদ মিলাইয়া); ইনি রাজার পক্ষ হইতে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের দক্ষিণা ধার্য্য করিয়া দিতেন, ধর্ম ও জাতসম্পকীয় বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার করিতেন, পাপাচার ও ধর্মভ্রষ্টতার শাস্তি এবং প্রায়শ্চিত্ত বিধির হুকুম দিতেন।
(৮) ব্যায়াধীশ (ফাবসী, কাজী-উল-কুজাং), অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি (চীফ জাষ্টিস); ধর্ম্ম-সম্বন্ধীয় মামলা ছাড়া অপব সব বিবাদের বিচারভার ইহার হাতে ছিল। ইহাদের মধ্যে সেনাপতি ছাড়া আর সকলেই জাতিতে ব্রাহ্মণ, কিন্তু ব্রাহ্মণ হইলেও (দানাধ্যক্ষ ও ন্যায়াধীশ ভিন্ন) অপর পাঁচজন অনেক সময় সৈন্যদলের নেতা হইয়া যুদ্ধে যাইতেন, এবং ক্ষত্রিয়ের অপেক্ষা কোন অংশে কম বীবত্ব বা রণ-চাতুর্য্য দেখাইতেন না। ফর্মান, দানপত্র, সন্ধিপত্র প্রভৃতি সমস্ত বড বড সরকাবী কাগজে প্রথমে রাজার মোহর, তাহার পর পেশোয়ার মোহর, এবং সর্বনীচে অমাত্য মন্ত্রী সচিব ও সুমন্ত -এই চারি প্রধানের স্বাক্ষর থাকিত।
বরত্তমাওনমান যুগে বিলাতে মন্ত্রীসভা (ক্যাবিনেট)ই দেশের প্রকৃত শাসনকর্তা; তাহারা সব বিভাগে নিজ হুকুম চালান, যুদ্ধ সন্ধি রাজস্ব শিক্ষা সর্ববিষয়ে রাজ্যের নীতি স্থির করেন। রাজা তাহাদের মত মানিতে বাধ্য, কারণ তাহাদের পশ্চাতে দেশের অধিকাংশ লোক আছে এবং রাজা তাহাদের উপদেশ অনুসারে কাজ না করিলে তাহারা রাগিয়া পদত্যাগ কবিবেন, জনসাধারণ ক্ষেপিয়া উঠিবে, এবং রাজাকে অপদস্থ (হয়ত পদচ্যুত) হইতে হইবে। কিন্তু শিবাজীর উপর মারাঠী অষ্ট প্রধানদের কোন ক্ষমতাই ছিল না; তাহারা রাজার ফেনী (সেক্রেটারি) মাত্র, বাজার কুম পালন করিতেন, তাঁহাদের কোন উপদেশ শুনা না শুনা রাজার ইচ্চজা প্রধানের। কোন বিষয়েই রাজনীতি বাঁধিয়া দিতে পারিতেন না, এমন কি তাহাদের নীচের কর্মচারীরা পর্যন্ত বিভাগীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজার কাছে আপীল করিতে পারিত। আর এই অষ্ট প্রধানের প্রত্যেকেই স্ব স্ব প্রধান, হিংসাপরবশ,ইংরাজ ক্যাবিনেটের সদস্যদের মত সুশৃঙ্খল, একজোট বাধা দল ছিল না।
লেখকেরা, এবং অনেক স্থলে হিসাবরক্ষকেরা সকলেই জাতিতে কায়স্থ ছিলেন (চিটনবিস, ফর্দিনবিস ইত্যাদি)। সৈন্যদের বেতনের শিবাজীর রাজ্য এবং শাসন-প্রণালী হিসাব লিখিত “সবনিস” উপাধিধারী এক শ্রেণীর কর্মচারী। ইহাদের পদ সামান্য হইলেও প্রভাব ছিল খুব বেশী। শিবাজীর কর্মচারীরা (বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ সুদাব, থানাদার প্রভৃতি) অতি নির্লজ্জভাবে পীড়ন করিয়া ঘুষ লইত এবং রাজস্ব আত্মসাৎ করিয়া টাকা জমাইত।