সুতরাং বম্বের ইংরাজদের সৈন্য ও রণপোত মারাঠাদের খাদেরী হইতে তাড়াইয়া দিতে আসিল। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৬৭৯ ইংরাজ ও মারাঠাদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হইল; ইংরাজ হারিলেন, কারণ ইহা প্রকৃত প্রস্তাবে যুদ্ধই ছিল। বড় বড় ইংরাজ-জাহাজগুলি তীর হইতে দূরে থামিয়া খাদেরী উপসাগরে ঢুকিতে দেরি করিতেছিল, কারণ তখও সেখানকার জলের গভীরতা মাপা হয় নাই। এমন সময়ে প্রধান সেনাপতির আজ্ঞা অমান্য করিয়া, লেফটেনান্ট ফ্রান্সিস থর্প মাত্র তিন খানা পদাতিক-ভরা তোপহীন ছোট শিবাড (মালের নৌকা) সঙ্গে লইয়া ঐ দ্বাপে নামিবার চেষ্টা করিলেন। তীর হইতে তাহাদের উপর গোলাগুলি বর্ষণ হইতে লাগল। থর্প এবং আর দুই জন ইংরাজ মারা পড়িল, অনেকে জখম হইল, আর অনেকে তীরে নামিবার পর মারাঠাদের হাতে বন্দী হইল। থর্পের শিবাডখানা শত্রুরা দখল করিল; আর দুখানা বাহির সমুদ্রে পলাইয়া গেল।
১৮ই অক্টোবর দ্বিতীয়বার জলযুদ্ধ হইল। সেদিন প্রাতঃকালে দৌলত খাঁ ৬০ খানা রণপোত লইয়া আক্রমণ করিলেন। ইংরাজদের আটখানা মাত্র জাহাজ ছিল, তাহার মধ্যে ‘রিভেঞ্জ’ নামক ফ্রিগেট ও দুইখানা ঘুরা বড়, বাকী সব ছোট; এগুলিতে দুইশত ইংরাজ-সৈন্য এবং দেশী ও সাহেব নাবিক ছিল। চৌগ-দুর্গের কিছু উত্তরে তীরের আশ্রয় হইতে বাহির হইয়া মারাঠা-জাহাজগুলি সামনের গলুই হইতে তোপ দাগিতে দগিতে এত দ্রুত অগ্রসর হইল যে খান্দেরীর বাহিরে ইংরাজ পোতগুলি নোঙর তুলিয়া অগ্রসর হইবার সময় পাই না। আধ ঘণ্টার মধ্যে ইংরাজদের ‘ডোভার’ নামক ঘুরাবে সার্জেন্ট মলভোরার ও জনকয়েক গোরা অত্যন্ত কাপুরুষতার সহিত আত্মসমর্পণ করিল এবং জাহাজ শুদ্ধ সকলেই মারাঠাদের হাতে বন্দী হইল।[২] অপর ছয়খানি ছোট ইংরাজজাহাজও ভয়েরণস্থল হইতে দূরে রহিল। কিন্তু এক সিংহই সহস্র শৃগালকে হারাইতে পারে। চারিদিকে শত্রুপোতের মধ্যে রিভেঞ্জ’ ফ্রিগেট নির্ভয়ে খাড়া রহিয়া, তোপের গোয় পাঁচখানা মারাঠী গলবট ডুবাইয়া দিল, এবং আরও অনেকগুলির এমন দশা করিল যে দৌলত খাঁ নিজ পোত লইয়া নাগোৎয়নায় পলাইয়া গেলেন; রিভেঞ্জ তাহার পিছু পিছু ছুটিল। দুইদিন পরে দৌলত খাঁঁ খাড়ো হইতে আবার বাহির হইলেন বটে, কন্তু ইংরাজ-জাহাজ তাঁহার দিকে আসিতেছে দেখিয়া ফিরিয়া পলাইলেন। নবেম্বরের শেষে সিদ্দি কাসিম ৩৪খান জাহাজ লইয়া ইংরাজদের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং দুই দলই খালেরীর উপর প্রত্যহ গোলা বর্ষণ করিতে লাগিলেন।
কিন্তু এই সব যুদ্ধর খরচ এবং শিবাজীর রাজ্যে তাহাদের বাণিজ্য বন্ধ হইবার ভয়ে ইংরাজদের কথার্ত্তাএয়া ভীত হইলেন। তাহাদের অর্থ ও লাক কম; গোরা সৈন্য মরিলে নূতন লোক পাওয়া কঠিন। সুতরাং তাঁহারা শিবাজীকে খুব মিষ্ট কবি চিঠি লিখিয়া মিটমাট করিয়া ফেলিলেন। জানুয়ারি মাসে ইংরাজ-রণপোতগুলি খান্দেরীর উপসাগর ছাড়িয়া বম্বেতে ফিরিল।
সিদ্দির সহিত জলযুদ্ধ
কিন্তু সিদ্দি কাসিম খালেরীর পাশে আরো দ্বীপ দখল করিয়া কামান চড়াইয়া দেওয়াল গাঁথিয়া (৯ই জানুয়ারি ১৬৮০) সেখান হইতে ধাদেরীর উপর গোলা দাগিতে লাগিলেন। দৌলত খাঁ নাগোৎনা খাডী হইতে নৌকাসহ আসিয়া দুই রাত্রি আন্দেরী-দখলের বৃথা চেষ্টা করিলেন। ২৬ জানুয়ারি তিনি তিনদিক হইতে আন্দেীরী আক্রমণ করিলেন। চারি ঘন্টা ধরিয়া যুদ্ধ হইল; অবশেষে মারাঠারা পরাস্ত হইয়া চৌলে ফিবিয়া গেল। তাদের চারিখানা ঘুরাব ও চারিখানা ছোট জাহাজ ধ্বংস পাইল, দুইশত সৈন্য মরিল, একশত জখম হইল, আর অনেকে শত্রুহস্তে বন্দী হইল। দৌলত খাঁ নিজে পায়ে বিষম আঘাত পাইলেন। সিদ্ধির তরফে একখানিও জাহাজ নষ্ট হইল না, এবং মাত্র চারিজন লোক হত এবং সাতজন আহত হইল।
- অষ্টিক (১৬৭২), নিকলস (১৬৭), হেনরি আকসিন্ডেল(১৬৭৫)।
- শিবাজী সুরগড় দুর্গে ইহাদেব আবদ্ধ বাখেন। সেখানে ৬ই নবেম্বর বন্দী ছিল— ২০জন ইংরাজ ফরাসী ও ডচ, ২৮ জন পোর্তুগীজ অর্থাৎ ফিরিঙ্গি, এবং ৯জন খালাসী।
১২. কানাড়ায় মারাঠা-প্রভাব
দ্বাদশ অধ্যায় – কানাড়ায় মারাঠা-প্রভাব
কানাড়া দেশ-বর্ণন
শিবাজী এত ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে অভিযান ও দেশজয় করেন যে তাহার সবগুলির বিস্তৃত বর্ণনা অনাবশ্যক। দক্ষিণ-কোঁকন এবং উত্তর-কানাড়ায় (অর্থাৎ গোয়ার উত্তর ও দক্ষিণের কুলদেশে) তিনি কি করিয়াছিলেন এখানে তাহাই বলা হইবে। বম্বের পশ্চিম-কুলে রত্নগিরি এবং উত্তরকানাড়া জেলায় কতকগুলি বন্দর ছিল,—যথা রাজাপুর, খারেপটন, বিনগুরলা, মালবন, কারোয়ার, মিরজান, ইত্যাদি। ইহার অনেক গুলিতে ইউরোপীয় বণিকদের কুঠ এবং জাহাজ লাগিবার ঘাট ছিল। মহা উর্ব্বর কানাড়া দেশ হইতে মরিচ, এলাচ, মসলিন্ কাপড, রেসম, গালা (লাক্ষা) প্রভৃতি অনেক মূল্যবান মাল এই সব বন্দরের ভিতর দিয়া দেশ-বিদেশে রপ্তানী হইত, আর ইহাতে এদেশে অগাধ ধন জমিত।
‘রুস্তম্-ই-জমা’-উপাধিধারী এক বিজাপুরী ওর অধীনে দক্ষিণকোঁকন ও কানাড়া ছিল। শিবাজী কয়েকবার আক্রমণ করিয়া ১৬৬৪ সালের মধ্যে গোয়র উত্তরে সব দেশ, অর্থাৎ রত্নগিরি ও সাবস্ত-বাড়ী, নিজ রাজ্যভুক্ত করিলেন। কিন্তু গোয়ার দক্ষিণ ও পূর্বে বিজাপুরী-রাজ্যে অধিকার বিস্তার করিতে তাঁহাকে অনেক বাধা পাইতে হইয়াছিল; বহু বিলম্বে তিনি এই কার্য্যে আংশিক মাত্র সফল হন। পশ্চিম-কানাড়ার অধিত্যকায় দুইটি বড় হিন্দু রাজ্য ছিল,—বিদনুর এবং সোন্দা। ১৬৬৩ সালে বিজাপুরী সুলতানের আক্রমণে বিদনুরের রাজা কাবু হইয়া পড়েন এবং ৩৫ লক্ষ টাকা নজর দিতে বাধ্য হন। তাহার পব প্রায়ই বিজাপুরী সৈন্য এই দেশে ঢুকিত, এখন মারাঠারাও সেই পথ ধরিল। রুস্তম-ই-জমান শিবাজীর বংশের দুপুরুষের বন্ধু, তিনি কখনও মারাঠাদের বিরুদ্ধে লাগিয়া পড়িয়া যুদ্ধ করিতেন না, বাহিরে লড়াই-এর ভাব দেখাইয়া সুলতানকে ভুলাইতেন মাত্র। একথা দেশের সকলে, এমন কি ইংরাজ-কুঠীর সাহেবেরাও জানিত।