জঞ্জিরাব বিপ্লব এবং সিদ্দি কাসিমেব দণ্ডা জয়
শিবাজী যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন প্রায় প্রত্যেক বৎসরই জঞ্জিরা আক্রমণ করিতেন; এই সকল একঘেয়ে নিষ্ফল চেষ্টার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া অনাবশ্যক। ১৬৬০-৭০ সালে তিনি জিদের সহিত অতি ভীষণ যুদ্ধ করিয়া সিদ্দি-সর্দার ফতই খাঁকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিলেন; অন্নাভাবে জঞ্জিরার পতন হয় আর কি! অথচ সিদ্দিদের উপরেব রাজা আদিল শাহর নিকট হইতে কোনপ্রকার সাহায্যের আশা নাই। তখন ফতহ, খাঁ টাকা ও জাগীর লইয়া শিবাজীকে ঐ দ্বীপ ছাড়িয়া দিতে সম্মত হইলেন। কিন্তু অপর তিনজন সিদ্দি-প্রধান তাঁহাকে বন্দী করিয়া জঞ্জিরা ও সিদ্দি জাহাজগুলির কর্ত্তৃত্ব নিজ হাতে লইলেন। মুঘল-বাদশাহ সিদ্দিকে পুরুষানুক্রমে “ইয়াকুৎ খা” উপাধি ও বার্ষিক তিন লক্ষ টাকা বেতন দিয়া নিজ চাকর করিয়া, সমুদ্রে পাহারা দিবার ভার দিলেন। সিদ্দি কাসিম হইলেন জঞ্জিরার, আর সিদ্ধি খয়রিয়ৎ সূলভূমির শাসনকর্ত্তা, এবং সিদ্দি সম্বল জাহাজগুলির নেতা (য়্যাডমিরাল, আমীর-আল-বহর।) সিদ্দি কাসিম বড় চতুর সাহসী ও পরিশ্রমী লোক। তিনি সুশাসনে এবং কাজকর্মে সর্বদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিয়া যুদ্ধে জাহাজ ও গোলাবারুদ বাড়াইলেন, অনেক মারাঠা-জাহাজ ধরিয়া ধনলাভ কবিলেন। অবশেষে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৬৯১ সালে, যখন দণ্ডা-দুর্গের মারাঠা-রক্ষীগণ সারাদিন হোলী উৎসবে মাতিয়া, মদ খাইয়া, ক্লান্ত-অবস্থায় রাত্রে অসাবধান হইয়া ঘুমাইতেছিল, তখন কাসিম গোপনে চল্লিশখানা জাহাজে সৈন্য লইয়া নিঃশব্দে দণ্ডার সমুদ্র-তীরের ঘাটে (অর্থাৎ দুর্গের দক্ষিণ মুখে। পৌঁছিলেন। এদিকে সিদ্দি খয়রিয়ৎ পাঁচশত সেনা লইয়া স্থলের দিকের দেওয়ালে (অর্থাৎ দুর্গের উত্তর-পূর্বমুখে) গিয়া মহাবাদ্য ও গোলমালের সহিত সেই দেওয়াল আক্রমণ করবার ভান করিলেন। মারাঠা-সৈন্যের অধিকাংশই এই দ্বিতীয় দিকে ছুটিল; অব সেই অবসরে কাসিম বিনা বাধায় ঘাটের দেওয়াল বাহিয়া উঠিয়া দুর্গে ঢুকিলেন। তাঁহার জনকতক লোক মরিল বটে, কিন্তু সেখানে মারাঠাদের যে-কয়জন রক্ষী ছিল তাহারা পরাস্ত হইয়া পলাইল। কাসিম দুর্গের মধ্যে আরও অগ্রসর হইলেন। এমন সময় হঠাৎ আগুন লাগিয়া দুর্গের বারুদের গুদাম ফাটিয়া যাওয়ায় মারাঠা কিলাদার এবং দুই পক্ষের অনেক লোক পুড়িয়া মরিল। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সৈন্যদল স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। কাসিম অমনি চেঁচাইয়া উঠিলেন, “খাস! খাসসু (তাহার রণ-বাণী)! বীরগণ, আশ্বস্ত হও। আমি বঁচিয়া আছি, আমার কোন জখম হয় নাই।” তাহার পর শত্রু কাটিতে কাটিতে অগ্রসর হইয়া পূর্বদিক হইতে আগত খয়রিয়তের দলের সহিত মিলিলেন, এবং সমস্ত দুর্গ দখল করিয়া মারাঠাদের নিঃশেষ করিয়া দিলেন।
শিবাজী জঞ্জিরা লইবার জন্য দিনরাত ভাবিতেছেন, আর কিনা তাঁহার হাত হইতে দণ্ডা পর্যন্ত চলিয়া গেল। এই সংবাদে তিনি মর্ম্মাহত হইলেন। গল্প আছে যে, রাত্রিতে আগুন লাগিয়া বারুদের গুদাম উড়িয়া যাওয়ার সময় তিনি চল্লিশ মাইল দূরে নিজ গড়ে ঘুমাইতেছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া গেল; তিনি বলিলেন “মনটা কেমন করিতেছে। নিশ্চয়ই দণ্ডায় কোন বিপদ ঘটিয়াছে।”
এই বিজয়ের পর কাসিম ঐ অঞ্চলে আরও সাতটি দুর্গ মারাঠাদের হাত হইতে উদ্ধার করিলেন এবং পরাজিত লোকদের উপর চূড়ান্ত অত্যাচার করিলেন। শিবাজী ও শম্ভুজী তাহাদের রাজত্বকালে এই প্রদেশ পুনরায় দখল করিবার অনেক চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। জাহাজ দিয়া অপর পক্ষকে চূড়ান্ত পরাজিত করিতে সাহায্য করিবার জন্য শিবাজী ও বাদশাহ প্রত্যেকেই বম্বের ইংরাজদের সাধিতে লাগিলেন। কিন্তু ইংরাজেরা বণিকের উচিত শান্তিতে রহিলেন; ফরাসী কোম্পানী কিন্তু এই ফাঁকে গোপনে শিবাঙ্গীকে ৮০টা ছোট তোপ এবং দু’ হাজার মণ সীসা বেচিয়া একচোট লাভ করিয়া লইল। ডচেরা শিবাজীর নিকট প্রস্তাব করিল, “আপনি সৈন্য দিন, আমরা জাহাজ দিব; উভয়ে একজোটে বম্বে আক্রমণ করিয়া ইংরাজদের বেদখল করিব, আর তাহার পর দণ্ডা কাড়িয়া লইয়া আপনাকে দিব।” কিন্তু শিবাজী এ কথায় কান দিলেন না। তাহার পর কত বৎসর ধরিয়া ঢিমে তালে এই যুদ্ধ চলিতে থাকিল। দুই পক্ষই অমানুষিক অত্যাচার করিতে লাগিল।
শিবাজীব নৌ-যুদ্ধ
১৬৭৪ সালের মার্চ মাসে সিদ্দি সম্বল সাতবলী নদীর মুখের খাড়ীতে ঢুকিয়া শিবাজীর নৌ-সেনাপতি দৌলত খাঁকে আক্রমণ করিলেন বটে, কিন্তু শেষে তাহাকে পরাস্ত হইয়া ফিরিতে হইল; এই যুদ্ধে দুই পক্ষেরই প্রধান সেনাপতি আহত হন এবং একশত ও ৪৪ জন লোক মারা পড়ে। সিদ্দি সম্বল অন্যান্য হাবশীদের সঙ্গে ঝগড়া করায় তাহাকে নৌ-সেনাপতির পদ হইতে দূর করিয়া দেওয়া হইল; তিনি অবশেষে (১৬৭৭ সালের নবেম্বব-ডিসেম্ববে) স্বজাতির সঙ্গ ও জাহাজ ছাডিয়া নিজ পরিবার ও অনুচর লইয়া শিবাজীর অধীনে চাকরি লইলেন।
খালেবী দ্বীপ লইয়া ইংরাজের সহিত শিবাজীর যুদ্ধ
জঞ্জিরা-জয়ে হতাশ হইয়া শিবাজী নিজে একটি জলবেষ্টিত দুর্গ স্থাপন করিবার ইচ্ছায় কাছাকাছি আর একটি দ্বীপ খুঁজিয়া বাহির করিলেন। ইহার নাম খান্দেরী, বম্বের এগার মাইল দক্ষিণে এবং জঞ্জিরার ৩০ মাইল উত্তরে। ১৬৭৯ সেপ্টেম্বরে তাঁঁহআর দেড়শত লোক চারিটি কামান লইয়া ময়া-নায়কের অধীনে জাহাজে আসিয়া এই ছোট শূন্য দ্বীপটি দখল করিল, এবং তাড়াতাড়ি পাথর ও মাটির দেওয়াল তুলিয়া ইহার চারিদিক ঘিরিয়া দিল। রাজা এই-সব খরচের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করিলেন। ইহাতে ইংরাজদের ভয় হইল, কারণ বম্বেতে যে-সব জাহাজ যাতায়াত কবে সেগুলি খাদেরে হইতে অতি স্পষ্ট দেখা যায় এবং শীঘ্র আক্রমণ করা সম্ভব। এই খান্দেরী শত্রুর অভেদ্য দুর্গ হইয়া উঠিলে, ইহার আশ্রয় হইতে মাঠা যুদ্ধ-জাহাজের পক্ষে সমুদ্রে ইংরাজবাণিজ্যপোত ধ্বস করা সহজ হইবেব।