সিদ্দিদের সহিত মারাঠাদের অশেষ যুদ্ধ
এজন্য শিবাজীর জীবনে ব্রত হইল জঞ্জির দ্বীপ অধিকার করিয়া পশ্চিম-কুলে সিদ্দিব প্রভাব একেবারে লোপ করা। এই কাজে তিনি অসংখা সৈন্য এবং জলের মত টাকা খরচ করিতে লাগিলেন।
কিন্তু মারাঠীদের তোপ ভাল ছিল না তোপ চালানে দক্ষতা একেবারেই ছিল না। আর তাহাদের জাহাজগুলি হাবশী-জাহাজের তুলনায় অবজ্ঞার জিনিষ। এই দুই শক্তির মধ্যে যুদ্ধটা বাঙ্গলার ছেলেভুলান গল্পেব “সুন্দববনের বাঘ ও কুমীবেব যুদ্ধের” মত হইল। শিবাজীর সৈন্য অসংখ্য, স্থলপথে অজেয়, অপর দিকে হাবশীবা জল-যুদ্ধে দুর্গ রক্ষা করিতে তেমনি শ্রেষ্ঠ, কিন্তু তাহাদের স্থল-সৈন্য এক হাজাবের বেশী নয়।
শিবাজী ১৬৫৯ সাল হইতে কোলাবা জেলাযক্রমে বেশী বেশী সৈন্য পাঠাইয়া হাবশী-রাজ্যের স্থলভূমি যথাসম্ভব দখল করিতে লাগিলেন। অনেক দিন ধরিয়া যুদ্ধ চলিল, কখন এপক্ষ আগাইয়া আসে, কখন ওপক্ষ। অবশেষে পণ্ডা-দুর্গ শিবাজী কাড়িয়া লইলেন, আর দ্বীপটি মাত্র সিদ্দিদেব দখলে থাকিল, তাহারা স্থলপথের দুর্গ ও শহরগুলি হারাইল। কিন্তু “পেট ভরিবাব জন্য” জাহাজে করিয়া আসিয়া রত্নগিরি জেলায় গ্রাম লুঠতে লাগিল। প্রতি বৎসর বর্ষার শেষে শিবাজী কয়েক মাস ধরিয়া স্থল হইতে জঞ্জিরা দ্বীপের উপব গোলা ছুঁডিতেন, কিন্তু তাহাতে কোনই ফল হইত না। তিনি বুঝিলেন যে নিজেব যুদ্ধ-জাহাজ থাকিলে তাহার পক্ষে মান-সম্রম ও রাজ্যরক্ষা করা অসম্ভব। তখন নৌবল-গঠনের দিকে তাহার দৃষ্টি পডিল।
শিবাজীর নোবল
শিবাজীর যুদ্ধ-জাহাজের এবং জলপথে প্রভাব-বিস্তারের ইতিহাস অতি স্পষ্ট ও ধারাবাহিকরূপে জানা যায়। ১৬৫৯ সালে কল্যাণ অধিকার করিবার পর তাহার নীচে সমুদ্রের খাড়ীতে (বম্বে হইতে ২৪ মাইল পূর্বে) শিবাজী প্রথম জাহাজ নির্মাণ করিয়া তাহা সমুদ্রে ভাসাইলেন। এই নবশক্তির জাগরণে পোর্তুগীজদের ভয় ও হিংসা হইল। পরে কোঁকন তীর দিয়া তাহার দ্রুত রাজ্য-বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ নির্মাণ, নৌ-সেনা ভর্তি এবং কুলে জাহাজের আশ্রয়স্থল-স্বরূপ জলদুর্গ ও বন্দর স্থাপন বাড়িয়া চলিল; “রাজা সমুদ্রের পিঠে জীন চড়াইলেন” (সভাসদ)।
শিবাজীর সর্ব্বসমেত চারিশত নৌকা ছিল। তাহা ছোট-বড় সকল শ্রেণীর, যথা ঘুরাব(তোপ-চড়ান, সমান ও উঁচু পাটাতনের যুদ্ধ-জাহাজ), গলবট(দ্রুতগামী পাতলা রণতরী), তরাণ্ডী, তারবে, শিবাভ এবং মাঁচোয়া (এ দুটি মালবাহী নৌকা), পগার ইত্যাদি। তাঁহার অধিকাংশ জাহাজই অতি হোট, ভারী ধাতুর পাতে মোড়া নহে, এবং তীর ছাড়িয়া বহুদূরে সমুদ্রে দীর্ঘকাল থাকিতে অক্ষম; কামানের এক গোলা লাগিলেই ডুবিয়া যাইত। ইংরাজকুঠীর অধ্যক্ষ এগুলির সম্বন্ধে বলিয়াছেন,—“এই সকল নৌকা অসার জিনিষ, ইংরাজদের একখানা ভাল যুদ্ধ-জাহাজ ইহাদের একশতখানা নির্বিঘ্নে ডুবাইয়া দিতে পারে।” অর্থাৎ যাহাকে “মশা মাছি” (mosquito craft) বলা হয়। সুরত বধে ও গোয়া ছাড়া পশ্চিম-কুলের প্রায় আর-সব বন্দরের জলের গভীরতা এত কম যে বড় বড় ভারী জাহাজ সেখানে ঢুকতে বা ঝড়ের সময় আশ্রয় লইতে পারে না। এজন্য প্রাচীনকাল হইতেই কোঁকন ও মালবারকুলের পণ্য-দ্রব্য ছোট এবং কম গভীর (চেপ্টা তলা) নৌকায় চালান করা হইত; এসব নৌকা তীরের কাছে যেখানে ছোট খাড়ী ও নদীতে তুফান দেখিলেই পলাইয়া রক্ষা পাইত। এই দেশের যুদ্ধ-জাহাজও সেই ধরণে তৈয়ার করা হইত; এগুলি হোট, বড় বড় বা বেশী সংখ্যার তোপ বহিতে পারিত না; ঝড়ে সমুদ্রে টিকিতে বা ডাঙ্গা ছাড়িয়া দূরে গিয়া একসঙ্গে অনেকদিন ধরিয়া পালে চলিবার জন্য প্রস্তুত নহে। তাহারা সংখ্যার জোরে যুদ্ধজয়ের চেষ্টা করিত, তোপের গোলাতে নহে। শিবাজীও নিজ পোতগুলি এই প্রাচীন ধরণের গঠন করেন, এবং জলযুদ্ধে এই পুরাতন রণ-নীতির কোন পরিবর্তন বা উন্নতি করেন নাই। কাজেই, ইরাজদের ত কথাই নাই, সিদ্দিদের কাছেও তাঁহার সহজেই পরাজয় হইত।
শিবাজীব নাবিক ও নৌ সনাপতি
শিবাজীর নো-বল দুই ভাগ করিয়া রাখা হয়;দরিয়া সারঙ্গ (মুসলমান) এবং ময়া-নায়ক হিন্দু) উপাধিধারা দুজন নৌ-সেনাপতি (অ্যাডমিরাল) ইহাদের নেতা। রত্নগিরি জেলার সমুদ্র-কুলের গ্রামগুলিতে জেলে ভণ্ডারী জাতের অনেক কৃষক আছে। ইহারা সমুদ্রে বাস করিতে,জাহাজ চালাইতে এবং নৌ-মুদ্ধে পুরুষানুক্রমে অভ্যস্ত। আগে ইহারা জলদস্যুগিরি করিত। ইহাদের দেহ পুষ্ট, সবল ও ব্যায়ামে গঠিত-স্থল-যুদ্ধে যেমন মারাঠা ও কুনবী জাত দক্ষ, ইহারাও ঠিক সেইমত। এই ভণ্ডারী এবং অপর কয়েকটি নাচ হিন্দুজাত—যথা,কোলী,সংঘর, বাঘের ও আংগ্রে (বংশ) হইতে শিবাজী অনেক উৎকৃষ্ট নৌ-সেনা ও নাবিক পাইলেন।
পরে (১৬৭৭ সালে) ঘরোয়া বিবাদের ফলে সিদ্দি সম্বল এবং তাহার ভ্রাতুস্পুত্র সিদ্ধি মিসরি, এই দুই হাবশী সর্দার আসিয়া শিবাজীর অধীনে কাজ লইলেন। তাঁহার অপর মুসলমান নৌ-সেনাপতির নাম দৌলত খাঁ কিন্তু জঞ্জিরার সিদ্দিদের জাহাজগুলি মারাঠাদের তুলনায় আকারে বড়, অধিকতর দৃঢ় ও সুরক্ষিত, এবং ভাল কামান এবং দক্ষতর যোঙ্কা দিয়া পূর্ণ; সুতরাং যুদ্ধে সিদ্দিরই জয়লাভ হইত, মারাঠারা অনেক বেশী লোক ও নৌকা হারাইয়া পলাইত। শিবাজীর অনেকগুলি জাহাজ তাহার নিজের এবং প্রজাদের মাল লইয়া, আরবের মোচা, পারস্যের বসরা, ইত্যাদি বন্দরে যাত্রা করিয়া নানাদেশে বাণিজ্য করিতে লাগিল। দক্ষিণের আট-দশটা বন্দর তাহার বাণিজ্যপোতের কেন্দ্র ও বিশ্রামস্থল ছিল। আর, তাহার যুদ্ধের নৌকাগুলি যথাসম্ভব সমুদ্রে অরক্ষিত শত্রু-পোত এবং কুলে অন্যান্য রাজার বন্দর লুঠ করিত। সুরত হইতে বাদশাহর প্রজাদের জাহাজগুলি তীর্থযাত্রী লইয়া মক্কা যাইবার পথে শিবাজীর দ্বারা আক্রান্ত হইত, কখন ধরা পড়িত। অবশেষে, আওরংজীব এই-সব জাহাজ রক্ষা, পশ্চিমসমুদ্রে পাহারা দেওয়া এবং শিবাজীর নো-বল দমন করিবার ভার অনেক টাকা বেতনে সিদ্দিদের উপর দিলেন।