শিবাজীও যে-টাকা একবার গ্রাস করিয়াছেন তাহা ফেরত দিতে নারাজ। এই অবস্থায় রাজাপুর-কুঠীর ক্ষতিপূরণের জন্য আলোচনার শেষ নিষ্পত্তি হওয়া অসম্ভব ছিল। ইংরাজের এক লক্ষ টাকা দাবি করিয়াছিল। শিবাজীর মন্ত্রীরা প্রথমে ক্ষতির পরিমাণ বিশ হাজার টাকা ধার্য্য করিলেন, পরে আটাশ হাজার এবং শেষে চল্লিশ হাজারে উঠিলেন। কিন্তু তাহাও নগদ নহে; ইহার মধ্যে ৩২ হাজার টাকা কতক নগদ কতক বাণিজ্য-দ্রব্য দিয়া শোধ হইবে, আর বাকী আট হাজার টাকা তিন হইতে পাঁচ বৎসর পর্যন্ত রাজাপুর বন্দরে ইংরাজদের আমদানী মালের দেয় মাশুল মাফ করিয়া পূরণ করা হইবে।
শিবাজীর রাজ্যাভিষেকের দরবারে (১৬৭৪ জুন) ইংরাজদূত হেনরি অকসিন্ডেন উপস্থিত হইয়া এই তিন শর্তে মিটমাট করিয়া এক সন্ধিপত্র সহি মোহর করাইয়া লইলেন:
(১) শিবাজী ক্ষতিপূরণ বাবদে ইংরাজদের চল্লিশ হাজার টাকা দিবেন। ইহার এক-তৃতীয়াংশ নগদ টাকা ও দ্রব্য (যেমন সুপারি) দিয়া শিবাজীর মৃত্যুর পূর্ব্বে শোধ হয়।
(২) তাহাব রাজ্যে ইংরাজ-কুঠীগুলি রক্ষা করিবেন। তদনুসারে ১৬৭৫ সালে রাজাপুরে ইংবাজেরা আবার কুঠী খোলেন।
(৩) তাহার রাজ্যের কূলে ঝড়ে কোন জাহাজ আসিয়া অচল হইয়া পডিলে অথবা ভগ্ন জাহাজের ভাসা মালগুলি পৌঁছিলে, নিজে জবৎ না করিয়া মালিককে ফিরাইয়া দিবেন।
কিন্তু শিবাজী ইংরাজদের চতুর্থ প্রার্থনা, অর্থাৎ তাহার রাজ্যে ইংরাজদের মুদ্রা প্রচলিত করিতে, কিছুতেই রাজি হইলেন না।
শিবাজীর সহিত ইংবাজ-বণিকদের সাক্ষাৎ
রাজাপুরের নূতন কুঠীর সাহেবেরা শিবাজীর সহিত ১৬৭৫ সালে দেখা করিয়া তাহার এই সুন্দর বর্ণনা লিখিয়া গিয়াছেন।
“রাজা২২ মার্চ্চ দুপুরবেলায় এখানে আসেন,সঙ্গে অনেক অশ্বারোহী পদাতিক ও দেড়শত পাল্কী। তাঁহার আগমনের সংবাদ পাইয়াই আমরা তাঁবু হইতে বাহির হইলাম এবং অল্প দূরেই তাঁহাকে পাইলাম। আমাদের দেখিয়া তিনি পাল্কী থামাইলেন এবং কাছে ডাকিয়া জানাইলেন, আমরা যে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি তাহাতে তিনি খুব খুশী হইয়াছেন, কিন্তু এই রৌদ্রের গরমে আমাদের এখন বেশীক্ষণ রাখিবেন না, বিকালে ডাকিবেন। ***
২৩ মার্চ্চ রাজা আসিলেন এবং পাল্কী থামাইয়া আমাদের কাছে ডাকিলেন। আমরা নিকটে গেলে তিনি হাত দিয়া ইঙ্গিত করিয়া আরও কাছে আসিতে বলিলেন। যখন আমি তাহার সামনে পৌঁছিলাম, তিনি কুতুহলে আমার লম্বা পরচুল নিজ হাতে নাড়িয়া-চডিয়া দেখিলেন এবং অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।***তিনি উত্তরে বলিলেন যে রাজাপুরে আমাদের সব অসুবিধা দূর করিবেন, এবং আমাদের যুক্তিসঙ্গত কোন অনুরোধই অগ্রাহ্য করিবেন না। ***
পরদিন আবার আমাদের ডাক পড়িল; দু’ঘণ্টা কথাবার্তার পর আমাদের দরখাস্তের মারাঠা-অনুবাদ তাহাকে পড়িয়া শুনান হইল; তিনি আমাদের সকল প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া ফর্ম্মা দিবেন, এ আশ্বাস দিলেন।”
জঞ্জিবার হাবশীগণ
ভারতের পশ্চিম-কুলে বম্বে শহর হতে ৪৫ মাইল দক্ষিণে জঞ্জিরা নামে পাথরের একটি ছোট দ্বীপ আছে। তাহার আধ মাইল পূর্বদিকে সমুদ্রের এক খাড়ী কোলাবা জেলার মধ্যে ঢুকিয়াছে। এই খাড়ীর মুখে উত্তর তীরে দণ্ডা নামক শহর, তাহার তিনদিকে সমুদ্রের জল; আর দণ্ডার দুইমাইল উত্তর-পশ্চিমে রাজপুরী নামক আর একটি নগর;[রাজাপুর বন্দর এখান হইতে অনেক দূরে, দক্ষিণে]। এইগুলি এবং ইহাদের সংলগ্ন জমি লইয়া একটি ছোট রাজ্য; তাহার অধিকারীরা হাবশী জাতীয়, অর্থাৎ আফ্রিকার এবিসিনিয়া দেশ হইতে আগত; ইহাদের ভীষণ কাল রং, মোটা ঠোঁট, কোঁঁকড়া চুল।
এই হাবশীরা তথায় কয়েক ঘর মাত্র; অসংখ্য ভারতীয় প্রজাদের মধ্যে বাস করিয়া তাহাদের নিজ প্রভুত্ব বজায় রাখিতে হইত। তাহারা সকলেই যুদ্ধে এবং জাহাজ চালাতে দক্ষ; অন্য কোন ব্যবসা করিত না; প্রত্যেকেই যেন এক একজন ছোটখাট ওমরা বা রাজপুত এইরূপ পদগৌরবে থাকিত। তাহাদের দলপতি পিতার উত্তরাধিকারসূত্রে হইতেন না; জাতির মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান কর্মদক্ষ বীরকে বাছিয়া নেতা স্বীকার করিয়া সকলে হক মানিত। হাবশী জাতি ভারতে বল-বিক্রম, শ্রম ও কষ্ট সহ্য করিবার শক্তি, যুদ্ধ ও রাজ্যশাসনে সমান দক্ষতা, এবং প্রভুভক্তির জন্য বিখ্যাত ছিল। আর, দৃঢ় স্থির মন, লোক চালাইবার ক্ষমতা, এবং জলযুদ্ধে পরিপক্কতায় ইউরোপীয় ভিন্ন অপর সব জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ইহাব। সিদ্দি। অর্থাৎ সৈয়দ বা উচ্চবংশজাত) নামে পরিচিত ছিল।
শিবাজী ও সিদ্দিদের শক্রতার কারন জঞ্জিরার পূর্বদিকের তীরভূমি কোলাবা জেলা। এখানে হাবশীদের খাদ্য জন্মে, রাজস্ব সংগ্রহ হয়, অনুচরগণ বাস করে। শিবাজী উত্তর কোঁকনে কল্যাণ, অর্থাৎ বর্তমান খানা জেলা, অধিকার করিয়া তাহার পরই কোলা জেলায় প্রবেশ করায়, হাবশীদের সহিত তাঁহাব সংঘর্ষ হইল। ইহা অনিবার্য্য; কারণ এই তটভূমি হারাইলে হাবশীরা না খাইতে পাইয়া মারা পডিবে; সুতরাং তাহারা দণ্ডা-বাজপুরী নিজ হাতে রাখিবার জন্য প্রাণপণ লড়িতে থাকিল। অপর পক্ষে, শিবাজীও জানিতেন যে তটভূমি ও জঞ্জিরা দ্বীপ হইতে হাবশীদের তাড়াইতে বা অধীন করিতে না পারিলে তাহার কোঁকন প্রদেশের স্থলভাগও অসম্পূর্ণ, অরক্ষিত, হইয়া পডিয়া থাকিবে; এই শত্রুরা জাহাজে করিয়া যেখানে সেখানে নামিয়া গ্রাম লুঠ ও প্রজাদের দাস করিয়া লইয়া যাইবে। “ঘরের মধ্যে ইদুর যেমন, সিদ্দিরাও ঠিক সেই ধরণের শত্রু” (সভাসদ), বিশেষত’, তাহারা হিন্দু প্রজাদের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করিত, ব্রাহ্মণদের ধরিয়া মেথরের কাজ করাইত, সাধারণ লোকদের নাক-কান কাটিয়া দিত। আর, ঐ দ্বীপের ও দুর্গের আশ্রয়ে নিজ জাহাজ রাখিয়া সমুদ্রে যখন-তখন মারাঠী জাহাজ ধরিতে পারি।