সমস্ত দেশ স্তম্ভিত, বজ্রাহত হইল। হিন্দুর শেষ আশা ডুবিল।
- লণ্ডনের রয়েল এসিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত ফারসী হস্তলিপির অনুবাদ।
১১. শিবাজীর নৌবল এবং ইংরাজ ও সিদ্দিদে
একাদশ অধ্যায় – শিবাজীর নৌবল এবং ইংরাজ ও সিদ্দিদের সহিত সংঘর্ষ
বাজাপুবের ইংরাজেরা শিবাজীর শত্রুতা করিল
১৬৫৯ সালের শেষে যখন শিবাজী বিজাপুর-রাজ্যে নানা স্থান জয় করিতে লাগিলেন, তখন ইংরাজদের প্রধান কুঠী ছিল সুরতে; এটি মুঘলসাম্রাজ্যের মধ্যে। বম্বে দ্বীপ তখনও পোর্তুগীজদের হাতে; ইংরাজেরা রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিবাহে যৌতুক-স্বরূপ পোর্তুগালরাজের নিকট হইতে ইহার আট বৎসর পর এই দ্বীপ পান, এবং আরও অনেক বৎসর পরে সুরত হইতে এখানে প্রধান অফিস উঠাইয়া আনেন। সুরতের পর রাজাপুর (রত্নগিরি জেলার বন্দর) এবং কারোয়ার (শোয়ার দক্ষিণে বন্দর), কানাড়ার অধিত্যকায় হুবলী এবং খাদেশ প্রদেশে ধরণগাঁও প্রভৃতি আরও কয়েকটি বড় ক্রয়-বিক্রয়ের শহরে ইংরাজদের কুঠী এবং কাপড় ও মরিচের আড়ৎ ছিল।
১৬৬০ সালে জানুয়ারির প্রথমেই শিবাজীর সৈন্যের রাজাপুর বন্দর কিছুদিনের জন্য দখল করে এবং সেখানকার ইংরাজ-কুঠীর অধ্যক্ষ হেনরি রেভিংটন্ বিজাপুরী আমলার মালপত্র কোম্পানীর সম্পত্তি বলিয়া মিথ্যা বর্ণনা করিয়া তাহা মারাঠাদের লইতে বাধা দেন। এই ঘটনা হইতে শিবাজীর সহিত ইংরাজদের প্রথম ঝগড়া বাধে, কিন্তু তাহা অল্পেই থামিয়া যায়।
ইহার কয়েক মাস পরেই যখন সিদ্দি জৌহর শিবাজীকে পানহালাদুর্গে ঘেরিয়া ফেলেন তখন সেই রেভিংটন এবং আর কয়েকজন ইংরাজ কতকগুলি বেঁটে তোপ (মর্টার) ও বোমার মত গোলা (গ্রেনেড) জৌহরকে বেচিবার জন্য সেখানে গিয়া এই অস্ত্রের বল দেখাইবার উদ্দেশ্যে শিবাজীর দুর্গের উপর কতকগুলি গ্রেনেড ছুড়িলেন। শিবাজী লক্ষ্য করিলেন যে ইংরাজ-পতাকার নীচু হইতে একদল সাহেব এই-সব গোলা মারিতেছে।
রাজাপুরের ইংরাজ কুঠী লুণ্ঠন
বিদেশী বণিকদের এই অকারণ শত্রুতার শাস্তি পর বৎসর মিলিল। ১৬৬১ সালের মার্চ্চ মাসে শিবাজী রত্নগিরি জেলা দখল করিতে করিতে রাজাপুর পৌঁছিয়া ইংরাজ কুঠীয়ালদিগকে বন্দী করিয়া লইয়া গেলেন, কুঠি লুঠ ও ছারখার করিবার পর তাহার মেঝে খুড়িয়া দেখিলেন যে টাকা লুকান আছে কিনা। ফলতঃ রাজাপুরে ইংরাজ বাণিজ্য একেবারে ধ্বংস পাইল। অনেক টাকা না দিলে ছাড়িয়া দিব না—এই বলিয়া সেই চারিজন ইংরাজ-বন্দীকে দুই বৎসর ধরিয়া নানা পার্বত্য-দুর্গে আটকাইয়া রাখিলেন।
কোম্পানীর কর্তারা বলিলেন যে, যখন রেভিংটন প্রভৃতি কর্মচারীরা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিবাজীর শত্রুতা করিয়া এই বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছে, তখন কোম্পানী টাকা দিয়া তাহাদের খালাস করিতে বাধ্য নহে। অবশেষে অনেক কষ্ট সহ্য করিবার পর তাহারা ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৩ এমনি ছাড়া পাইল।
তাহার পর কোম্পানী রাজাপুরের কুঠি লুঠ ও ধ্বংস করার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করিলেন; শিবাজী এজন্য নিজ দায়িত্বস্বীকার করেন না, কখনও বা খুব কম টাকা খেসারৎ দিতে চাহেন। এই লইয়া বিশ বৎসরেরও অধিক সময় তর্ক-বিতর্ক চিঠি লেখালেখি চলিল। ইংরাজের আশ্চর্য্য সহিষ্ণুতা ও জিদের সহিত দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিজেদের এই দাবি ধরিয়া রহিলেন, বারে বারে শিবাজীর নিকট দূত[১] পাঠাইতে লাগিলেন। পরে হুবলী, ধরণগাঁও প্রভৃতি স্থানের ইংরাজ-কুঠীও মারাঠারা লুঠ করে, এবং তাহার জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়া হইল। এ বিবাদ শিবাজীর জীবনকালে নিষ্পত্তি হইল না, অথচ এজন্য দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধও বাধিল! কারণ সে যুগে ইংরাজ ও শিবাজী অনেক বিষয়ে পরস্পরের মুখাপেক্ষী ছিলেন। বম্বে দ্বীপে তরকারী, চাউল, মাংস, জ্বালানী কাঠ কিছুই জন্মিত না; এগুলি পরপারে শিবাজীর দেশ হইতে না আসিলে, বম্বের লোক অনাহারে মারা যাইত। আর, শিবাজীর রাজ্যে লবণ মোমবাতী সৌখীন পশমী কাপড় (বনাত ও সকলাৎ) তোপ ও বারুদ ইংরাজেরাই আনিয়া দিতে পারিতেন। তা ছাড়া ইংরাজদের বেচা-কেনায় শিবাজীর প্রজাদের এবং পণ্যমাশুল হইতে রাজসরকারের অনেক টাকা আয় হইত। কাজেই এই ঝগড়া যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াইল না।
রাজাপুব-কুঠার ক্ষতিপূরণের দাবি
ইংরাজ-বণিকেরা বেশ বুঝিতেন যে, শিবাজীকে চটাইলে তাঁহার বিস্তৃত রাজ্যে তাঁহাদের বেচা-কেনা একেবারে বন্ধ হইয়া যাইবে; অথচ তাঁহাদের এমন শক্তি ছিল না যে যুদ্ধ করিয়া শিবাজীকে কাবু করেন বা তাহার নিকট হইতে প্রাপ্য টাকা আদায় করেন। তাহাদের একদিকে ভয় যে যদি তাহারা শিবাজীকে তোপ ও গোলা বিক্রয় না করেন তবে তিনি চটিয়া তাহাদের বাণিজ্য বন্ধ করিয়া দিবেন; অপর দিকেও বিপদ কম নহে,—মারাঠা-রাজকে এইরূপে সাহায্য করা হইয়াছে টের পাইলে মুঘল বাদশাহ রাগিয়া তাহার রাজ্য হইতে ইংরাজ-কুঠি উঠাইয়া দিবেন এবং বণিকদের কয়েদ করিবেন। ফরাসীরা এরূপ অবস্থায় অতি গোপনে কিছু ছোট ছোট তোপ ও সীসা শিবাজীকে বিক্রয় করেন।
চতুর ইংরাজ-কর্তারা নিজ স্থানীয় কর্মচারীদের লিখিয়া পাঠাইলেন— “এই উভয় সঙ্কটের মধ্যে এমন সাবধানে চলিবে যেন কোনপক্ষই রাগ করে। শিবাজীকে তোপ বারুদ বেচিবেও না, আবার বেচিতে খোলাখুলি অস্বীকারও করিবে না। অস্পষ্ট উত্তর দিয়া যত সময় কাটান যায় তাহার চেষ্টা করিবে। আব, আমরা আমাদেব জাহাজ ও তোপ লইয়া গিয়া হাবশী রাজধানী জয় করিতে তাঁহাকে সাহায্য করিতে পারি, এই লোভ দেখাইয়া আলোচনার সূত্রপাত করিবে, এবং তাঁহাকে এইরূপে দীঘকাল হাতে রাখিবে।”