ধনবৃদ্ধির সঙ্গে মালোজ অনেক জনহিতকর কাজ ও দানধর্ম্ম করিলেন। মন্দির-নির্ম্মাণ, ব্রাহ্মণ-ভোজন ছাড়া, সাতারা জেলার উত্তর অংশে মহাদেব পর্ব্বতের শিখরে শম্ভু-মন্দিরে চৈত্র মাসে সমবেত লক্ষ লক্ষ যাত্রীর জলকষ্ট নিবারণের জন্য তথায় পাথর কাটিয়া একটি বড় পুষ্করিণী খুঁড়িলেন। মহাদেব তুষ্ট হইয়া স্বপ্নে তাঁহাকে বর দিলেন, “আমি তোমার বংশে অবতীর্ণ হইয়া দেবদ্বিজকে রক্ষা করিব, দক্ষিণ দেশের রাজ্য তোমায় দিব।”
ধনে মানে বাড়িয়া কালক্রমে মালোজী মারা গেলেন, তাঁহার পর তাঁহার জমিদারী ও সৈন্যদল তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিঠোজী চালাইলেন। বিঠোজীর মৃত্যুর পর (অনুমান ১৬২৩ খৃষ্টাব্দে) শাহজী পৈত্রিক সম্পত্তির ভার পাইলেন,এবং ভোঁশলে বংশের সেনাদলের নেতা হইলেন। এই দল এতদিনে বাড়িয়া দু হাজার আড়াই হাজার লোক হইয়াছিল।
শাহজীর অভ্যুদয়
১৬২৬ সালে নিজামশাহী রাজ্যের সুদক্ষ মন্ত্রী, মালিক অম্বর আশী বৎসর বয়সে মারা গেলেন এবং তাঁহার পুত্র ফতে খঁ উজীর হইলেন। ইহার এক বৎসরের মধ্যেই দিল্লীর বাদশাহ জাহাঙ্গীর এবং বিজাপুরের সুলতান ইব্রাহিম আদিল শাহও প্রাণত্যাগ করিলেন। দাক্ষিণাত্যে ভীষণ গোলমাল ও যুদ্ধ বাধিয়া গেল।
শাহজীর কাজের উল্লেখ ইতিহাসে ১৬২৮ সালে প্রথম পাওয়া যায়। সেই বৎসর তিনি ফতে খাঁর আজ্ঞায় সসৈন্য মুঘল-রাজ্যের পূর্ব্ব-খান্দেশ প্রদেশ লুঠ করিতে যান, কিন্তু স্থানীয় মুঘল-সেনানীর হাতে বাধা পাইয়া ফিরিতে বাধ্য হন। ১৬৩০ খৃষ্টাব্দে আহমদনগর-রাজ্যে শেষ-ভাঙ্গন ধরিল। দরবারে দলাদলি যুদ্ধ ও খুন, শাসনে বিশৃঙ্খলা ও রাজ্যে অরাজকতা নিত্য ঘটিতে লাগিল। শাহজী এই সুযোগে নিজের জন্ম রাজ্য জয় করিতে শুরু করিলেন। কখন-বা তিনি মুঘলদের সঙ্গে যোগ দেন, কখন-বা বিজাপুর-রাজ আদিল শাহের সহিত; আবার কখনও বা নিজাম শাহের চাকরিতে ফিরিয়া আসেন। মুঘলেরা শেষ নিজামশাহ রাজধানী দৌলতাবাদ জয় করিয়া সুলতানকে বন্দী করিল (১৬৩৩)।
তখন শাহজী ঐ বংশের একজন বালককে নিজাম শাহ’ বলিয়া মুকুট পরাইয়া, নিজে সর্ব্বেসর্ব্বা হইয়া তিন বৎসর ধরিয়া পুণা-দৌলতাবাদ অঞ্চলে রাজ্য-পরিচালন করিতে লাগিলেন। কিন্তু ১৬৩৬ সাথে মুঘলদের সহিত যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া, সব ছাড়িয়া দিয়া বিজাপুর সরকারের চাকরি লইতে বাধ্য হইলেন।
শিবাজীর জন্ম ও বাল্যকাল
জীজা বাঈ-এর গর্ভে তাঁহার দুই পুত্র হয়,—শম্ভুজী(২) (১৬২৩) এবং শিবাজী (১৬২৭)। দ্বিতীয় পত্রের জন্মের পূর্ব্বে জীজাবাঈ জুন্নরশহরের নিকটস্থ শিবনের গিরিদুর্গে বাস করিতেছিলেন; দুর্গের অধিষ্ঠাত্র দেবী “শিবা-ভবানীর” নিকট তিনি ভাবী সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন এইজন্য পুত্রের নাম রাখিলেন “শিব” (দাক্ষিণাত্যের উচ্চারণ “শিবা)
১৬৩০ হইতে ১৬৩৬ পর্যত শাহজী নানা যুদ্ধবিগ্রহ, বিপদ ও অবস্থা পরিবর্ত্তনের মধ্যে কাটান। এজন্য তাঁহাকে নানা স্থানে ঘুরিতে হয়। তাঁহার স্ত্রী ও পুত্রদ্বয় শিবনের-দুর্গে আশ্রয় লইয়াহিল। তাহার পর ১৬৩৬ সালে মুঘলদের সঙ্গে তাঁহার যুদ্ধ মিটিল, এবং তিনি বিজাপুর-রাজসরকারে কার্য লইলেন বটে, কিন্তু মহারাষ্ট্রে আর রহিলেন না, মহীশূর প্রদেশে নুতন জাগীর স্থাপন করিতে চলিয়া গেলেন। সেখানে তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী তুকা বাঈ মোহিতে তাঁহার গর্ভজাত পুত্র ব্যঙ্কোজী (ওরফে একোজী)-কে লইয়া বাস করিতে লাগিলেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও দ্বিতীয় পুত্র যেন ত্যাজ্য হইল; তাহাদের বাসের জন্য পুণা গ্রাম এবং ভরণপোষণের ব্যয়ের জন্য ঐ জেলার ক্ষুদ্র জাগীরটি দিয়া গেলেন। জীজা বাঈ এখন প্রৌঢ়া, তাঁহার বয়স ৪১ বৎসর। তরুণবয়স্কা সুন্দরী সপত্নীর আগমনে তিনি স্বামী-সোহাগ হইতে বঞ্চিত হইলেন। জন্মের পর দশ বৎসর পর্যন্ত শিবাজী পিতাকে খুব কম সময় দেখিতে পাইয়াছিলেন, আর তাহার পর দুজনে সম্পূর্ণ পৃথক হইয়া গেলেন।
শিবাজীর মাতৃভক্তি ও ধর্ম্মশিক্ষা
স্বামীর অবহেলার ফলে জীজা বাঈ-এর মন ধর্ম্মে একনিষ্ঠ হইল। আগেও তিনি ধর্ম্মপ্রাণ ছিলেন, এখন একেবারে সন্ন্যাসিনীর মত জীবন যাপন করিতে লাগিলেন—যদিও উপযুক্ত সময়ে জমিদারীর আবশ্যক কাজকর্ম্ম দেখিতেন। মাতার এই ধর্ম্মভাব পুত্রের তরুণ হৃদয় অধিকার করিল। শিবাজী নির্জ্জনে বাড়িতে লাগিলেন; সঙ্গীহীন বালক, ভাই নাই, বোন নাই, পিতা নাই, এই নিঃসঙ্গ জীবনের ফলে মাতা ও পুত্র আরও ঘনিষ্ঠ হইলেন; শিবাজীর স্বাভাবিক মাতৃভক্তি শেষে দেবোপাসনার মত ঐকান্তিক হইয়া দাঁড়াইল।
শিবাজী বাল্যকাল হইতে নিজের কাজ নিজে করিতে শিখিলেন— অন্য কাহারও নিকট আদেশ বা বুদ্ধি লইবার জন্য তাঁহাকে অপেক্ষা করিতে হইত না। এইরূপে জীবন-প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দায়িত্ব জ্ঞান ও কর্ত্তৃত্বে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিলেন। বিখ্যাত পাঠান-রাজা শের শাহের বাল্যজীবনও ঠিক শিবাজীর মত; দুজনেই সামান্য জাগীর দারের পুত্র হইয়া জন্মান, বিমাতার প্রেমে মুগ্ধ পিতার অবহেলার মধ্যে বাড়িয়া উঠেন, বনজঙ্গল ঘুরিয়া, কৃষক ডাকাত প্রভৃতির সহিত মিশিয়া দেশ ও মানুষ সম্বন্ধে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেন, চরিত্রের দৃঢ়তা,শ্রমশীলতা ও স্বাবলম্বন নিজ হইতে শিক্ষা করেন, পৈত্রিক জাগীরের কাজ চালাইয়া নিজকে ভবিষ্যৎ রাজ্যশাসন কাজের উপযোগী করিয়া গড়িয়া তোলেন। দুজনেরই চরিত্র ও প্রতিভা একরূপ, দুজনেই ঠিক একশ্রেণীর ঘটনার মধ্য দিয়া বর্দ্ধিত হন।