মারাঠা নামক জাতের যে শাখায় শিবাজীর জন্ম, তাহার উপাধি “ভোঁশলে”। এই ভোঁশলে পরিবার দাক্ষিণাত্যে অনেকস্থলে ছড়াইয়া আছে, কিন্তু তাহারা রাজপুতদের বংশশাখার মত এক রক্তের টানে বাঁধা ছিল না, অথবা কোনো একজন দলপতির আজ্ঞায় চালিত হইত না। প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিবার লইয়া নিজ গ্রামে থাকিত, কোন সাধারণ গোষ্ঠীপতিকে মানিত না, বা জাতের মিলনে কখনও সমবেত হইত না। জমি-চাষ ও পশুপালনই তাহাদের জাতিগত ব্যবসা ছিল, যদিও মারাঠা জাতের দুই-চারিজন ধনী ও ক্ষমতাশালী প্রধান বা জমিদারের নাম মধ্যযুগের ইতিহাসে পাওয়া যায়। কিন্তু খৃষ্টীয় যোড়শ শতাব্দীর প্রথমে বহমানী-সাম্রাজ্য ভাঙিবার সময় এবং তাহার শতবর্ষ পরে আহমদনগরের নিজামশাহী রাজবংশের দ্রুত অবনতির বিপ্লবে, মারাঠারা এক মহাসুযোগ পাইল। দেশের রাজনৈতিক অবস্থার ফলে মারাঠা কৃষক-বংশের অনেক বলিষ্ঠ, চতুর ও তেজী লোক হাল ছাড়িয়া অসি ধরিল, সৈনিকের ব্যবসা আরম্ভ করিয়া পরে জমিদার ও রাজা হইতে লাগিল। কিরূপে কৃষকপুত্র ক্রমে ক্রমে দস্যুর সর্দার, ভাড়াটে সৈন্যের দলপতি, রাজ-দরবারের সন্ত্রান্ত সামন্ত, এবং অবশেষে স্বাধীন নরপতির পদে উঠতে পারিত তাহার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত—শিবাজী।
শিবাজীর পূর্ব্বপুরুষ
খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাবাজী ভোঁশলে পুণা জেলার হিঙ্গনী এবং দেবলগাঁও নামক দুইটি গ্রামের পাটেল (অর্থাৎ মণ্ডল)- এর কাজ করিতেন। গ্রামের অন্যান্য কৃষকগণের ক্ষেত্রের উৎপন্ন শস্যের এক অংশ পাটেল পদের বেতনস্বরূপ তাঁহার প্রাপ্য ছিল; ইহা ছাড়া তিনি নিজের কিছু ক্ষেতও চাষ করিতেন। এই দুই উপায়ে তাঁহার সংসার চলিত। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার দুই পুত্র মালোজী ও বিঠোজী প্রতিবেশীদের সহিত বনিবনা না হওয়ায় সপরিবারে গ্রাম ছাড়িয়া এলোরা পর্ব্বতের পাদদেশে বিরুল গ্রামে চলিয়া গেলেন। এখানে চাষবাসে আয় বড় কম দেখিয়া তাঁহারা সিন্ধখেড়ের জমিদার এবং আহমদনগর রাজ্যের সেনাপতি লখ্জী যাদব রাও-এর নিকট গিয়া সাধারণ অশ্বারোহী (বার-গীর্) সৈন্যের চাকরি লইলেন। প্রত্যেকের বেতন হইল মাসিক কুড়ি টাকা।
শাহজী ও জীজা বাঈ
যাদব রাও ভোঁশলেদেরই মত জাতে মারাঠা। মালোজীর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহজী দেখিতে বড় সুশ্রী ছিলেন, যাদব রাও এই বালকটিকে সোহাগ করিতেন এবং সঙ্গে করিয়া অন্তঃপুরে লইয়া যাইতেন। একদিন হোলীর সময় যাদব রাও নিজ বৈঠকখানায় বসিয়া বন্ধুবান্ধব অনুচরগণ লইয়া নাচ-গান উপভোগ করিতেছিলেন। পাঁচ বৎসরের বালক শাহজীকে এক কোলে এবং নিজের তিন বছরের কন্যা জীজা বাঈকে অপর কোলে বসাইয়া তাহাদের হাতে আবীর দিলেন এবং শিশু দুটির হোলী খেলা দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ভগবান মেয়েটিকে কি সুন্দর করিয়াই গড়িয়াছেন। আর শাহজীও রূপে ইহারই সামিল। ঈশ্বর যেন যোগ্যে যোগ্যে মিলন ঘটান!”
যাদব রাও হাসির ভাবে একথা বলিলেন, কিন্তু মালোজী অমনি দাঁড়াইয়া উচ্চস্বরে কহিলেন, “আপনারা সকলে সাক্ষী, যাদব রাও আজ তাঁহার কন্যাকে আমার ছেলের সঙ্গে বাগদত্তা করিলেন।” একথা শুনিয়া যাদব রাও ক্ষুণ্নমনে মেয়ের হাত ধরিয়া অন্তঃপুরে চলিয়া গেলেন; অন্যদিনের মত শাহজীকে সঙ্গে লইলেন না।
যাদব রাও-এর পত্নী গিরিজা বাঈ অতি বুদ্ধিমতী ও তেজস্বী বীর রমণী। (১৬৩০ সালে যখন নিজাম শাহ বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া দরবার মধ্যে হঠাৎ তাঁহার স্বামীকে খুন করেন, তখন গিরিজা বাঈ এই দুঃসংবাদে অভিভূত না হইয়া তৎক্ষণাৎ পরিবারবর্গ অনুচর ও ধন-সম্পত্তি লইয়া অশ্বপৃষ্ঠে রাজধানী হইতে বাহির হইলেন এবং দলবদ্ধভাবে কুচ করিতে করিতে নিরাপদ স্থানে পৌছিলেন। শত্রুপক্ষ তাঁহাকে বন্দী করিতে অথবা তাঁহাদের সম্পত্তি লুঠিতে পারিল না। মুসলমান ইতিহাস-লেখকেরা ঐ সময়ে তাঁহার স্থিরবুদ্ধি ও সাহসের খুব প্রশংসা করিয়াছেন।)
হোলীর মজলিসে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল সমস্ত শুনিয়া গিরিজা বাঈ রাগিয়া স্বামীকে বলিলেন, “কি! এই গরীব ভবঘুরে সামান্য ঘোড়সওয়ারের ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের সম্বন্ধ? বিবাহ সমান সমান ঘরেই সম্ভব। তুমি কি অবিবেচনার কাজই করিয়াছ। কেন উহাদের এই অন্যায় কথার উপযুক্ত জবাব দিলে না, এবং ধমকাইলে না?”
মালোজীর সংসারে উন্নতি
যাদব রাও পরদিনই দুই ভাইকে তাহাদের বেতন চুকাইয়া দিয়া চাকরি হইতে বরখাস্ত করিলেন। মালোজী ও বিঠোজী অগত্যা বিরুল গ্রামে ফিরিয়া আবার চাষ করিতে লাগিলেন। একদিন রাত্রে মালোজী ক্ষেতের শস্য পাহারা দিতেছেন, এমন সময় দেখিলেন, এক গর্ত্ত হইতে একটি বড় সাপ বাহির হইল, আবার তথায় ঢুকিল। মাটির তলে গুপ্তধন প্রাচীন সাপে রক্ষা করে এই বিশ্বাস সেকাল হইতে অনেক দেশে চলিয়া আসিতেছে। মালোজী ঐ গর্ত্ত খুঁড়িয়া সেখানে সাতটি লোহার কড়াই-ভরা মোহর পাইলেন।(১)
এতদিনে মালোজীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুরাইবার উপায় জুটিল। ঐ গুপ্তধন চামারা গ্রামের একজন বিশ্বাসী মহাজনের জিম্মায় রাখিয়া, তাহার কিছু খরচ করিয়া ঘোড়া, জীন, অস্ত্র ও তাম্বু কিনিয়া তিনি এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সজ্জিত করিলেন, এবং তাহাদের নেতা হইয়া ফল্টন গ্রামের নিম্বলকর-বংশীয় জমিদারের সহিত যোগ দিয়া লুটপাট আরম্ভ করিয়া দিলেন। অল্পদিনেই তাঁহার ক্ষমতা ও খ্যাতি এত বাড়িয়া গেল যে, অবসন্নপ্রায় নিজামশাহী-রাজা তাঁহাকে সরকারী সৈন্যমধ্যে ভর্তি করিয়া সেনাপতি উপাধি দিলেন। মালোজী আর সাধারণ ঘোড়সোয়ার বা চাষী নহেন, তিনি এখন ওমরা—যাদব রাও-এর সমপদস্থ। তখন যাদব রাও নিজ কন্যার সহিত শাহজীর বিবাহ দিলেন (সম্ভবতঃ ১৬০৪ খৃষ্টাব্দে)।