বাদশাহ অবাধ্য পলাতক শিবাজীকে শাস্তি দিবার অবসর পাইলেন না। ১৬৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমেই পারস্যরাজের আক্রমণের ভয়ে একদল প্রবল মুঘল-সৈন্য পাঞ্জাবে পাঠান হইল, আর তাহার পর বৎসর মার্চ্চ মাসে পেশোয়ার প্রদেশে যে ইউসুফজাই-জাতির বিদ্রোহ বাধিল তাহাতে বাদশাহর সমস্ত শক্তি বহুদিন ধরিয়া সেখানে আবদ্ধ বহিল।
বাদশাহ ও শিবাজীর মধ্যে আবার সন্ধি হইল কেন?
দেশে ফিরিয়া, শিবাজীও মুঘলদের সঙ্গে বিবাদ করিতে চাহিলেন না; তিন বৎসর পর্য্যন্ত শান্তভাবে রহিলেন, নিজরাজ্যের শাসনপ্রণালী গঠন এবং সুচারুরূপে জমির বন্দোবস্ত করিলেন; কোঁকন-প্রদেশে নিজ অধিকার বিস্তৃত করিতে লাগিলেন।
এ অবস্থায় বাদশাহর সঙ্গে সন্ধি করায় তাঁহার লাভ। তিনি মহারাজা যশোবন্ত সিংহকে লিখিলেন,—“বাদশাহ আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। নচেৎ আমার ইচ্ছা ছিল, তাঁহার অনুমতি লইয়া নিজবলে কান্দাহার দুর্গ কাড়িয়া লইয়া তাঁহাকে দিই। আমি শুধু প্রাণের ভয়ে আগ্রা হইতে পলাইয়াছি। মির্জা রাজা জয়সিংহ আমার মুরুব্বি ছিলেন, তিনি আর নাই। এখন আপনার মধ্যস্থতায় যদি আমি বাদশাহর ক্ষমা লাভ করি, তবে আমি আমার পুত্রের সহিত সৈন্যদলকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা মুয়ুজ্জমের অধীনে কাজ করিতে পাঠাইয়া দিতে পারি।”
যুবরাজ ও যশোবন্ত এই প্রস্তাব বিশেষভাবে সমর্থন করিয়া বাদশাহকে লিখিলেন। আওরংজীব সম্মত হইয়া শিবাজীর ‘রাজা’ উপাধি মঞ্জুর করিলেন। ১৬৬৭ সালের ৪ঠা নবেম্বর শম্ভুজী আসিয়া আওরঙ্গাবাদে যুবরাজ মুয়জ্জমের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। পরবর্ত্তী আগষ্ট মাসে প্রতাপরাও (নূতন সেনাপতি) এবং নিয়াজীর অধীনে শিবাজীর একদল সৈন্য আসিয়া বাদশাহর কাজ করিতে লাগিল। তজ্জন্য শম্ভুজীকে পাঁচ হাজারী মনসবের উপযুক্ত জাগীর বেরার প্রদেশে দেওয়া হইল। এইরূপে “দুই বৎসর পর্য্যন্ত মারাঠা-সৈন্য মুঘল-রাজ্যের জমি হইতে পেট ভরাইল, শাহজাদাকে বন্ধু করিল।” [সভাসদ]
১৬৬৭, ১৬৬৮, ১৬৬৯ এই তিন বৎসর শিবাজী শান্তিতে কাটাইলেন,—বিজাপুর বা মুঘল-রাজ্যে কোন উপদ্রব করিলেন না। তাহার পর ১৬৭০ সালের প্রথমেই আবার বাদশাহর সঙ্গে যুদ্ধ বাধিল। ইহার কারণ নানা লোকে নানা রকম বলে। এক গ্রন্থে আছে, নিন্দুকেরা আওরংজীবকে জানাইল যে শাহজাদা মুয়জ্জম শিবাজীর সহিত গাঢ় বন্ধুত্ব করিয়া তাঁহার সাহায্যে স্বাধীন হইবার চেষ্টায় আছেন, এবং এই কথা শুনিয়া বাদশাহ শিবাজীর পুত্র ও সেনাপতিদের হঠাৎ বন্দী করিবার জন্য মুয়ুজ্জমকে হুকুম পাঠাইলেন; কিন্তু কুমার বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া গোপনে মারাঠাদের ইঙ্গিত করিলেন, তাহারা আওরঙ্গাবাদ হইতে দলবল লইয়া রাত্রে পলাইয়া গেল।
অপর এক বিবরণ এই যে, বাদশাহ ১৬৬৬ সালে আগ্রা যাইবার জন্য শিবাজীকে যে একলক্ষ টাকা অগ্রিম দেন, এখন আয়বৃদ্ধি করিবার চেষ্টায় তাহা তাঁহার বেরারের নূতন জাগীর জব্ৎ করিয়া আদায় করিতে হুকুম দিলেন। তাহাতে শিবাজী চটিয়া বিদ্রোহী হইলেন।
আসল কথা, এই তিন বৎসরে শিবাজী বলবৃদ্ধি ও এবং রাজ্যের বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন; এখন দেখিতে চাহিলেন যুদ্ধ করিলে কত লাভ হয়।
- বাদশাহর দেহ হইতে অশুভ দৃষ্টির প্রভাব দূর করিবার জন্য যে টাকা বা রত্ন থালায় করিয়া তাঁহার মাথার চারিদিকে ঘুরাইয়া পরে লোকজনদের মধ্যে ছড়াইয়া দেওয়া হইত, তাহার নাম ছিল নিসার।
০৭. শিবাজীর স্বাধীন রাজ্য স্থাপন
সপ্তম অধ্যায় – শিবাজীর স্বাধীন রাজ্য স্থাপন
মুঘলদের হাত হইতে দুর্গ-উদ্ধার
আওরংজীবের দরবার হইতে পলাইয়া আসিয়া শিবাজী তিন বৎসর (১৬৬৭-১৬৬৯) চুপচাপ ছিলেন। তাহার পর, ১৬৭০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমেই আবার যুদ্ধ আরম্ভ করিয়া দিলেন। দাক্ষিণাত্যে মুঘলকর্ম্মচারীরা কিছুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। শিবাজী দ্রুতগতিতে চারিদিকে সতেজ আক্রমণ করিয়া গোলমাল সৃষ্টি করায় তাহারা একেবারে বিব্রত হইয়া পড়িল। তাহাদের অধীন কত গ্রাম লুঠ হইল, পুরন্দর-সন্ধিতে পাওয়া সাতাইশটি দুর্গের মধ্যে অনেকগুলি বাদশাহর হাতছাড়া হইল। মুঘল-কর্ম্মচারীদের অনেকে নিজ নিজ দুর্গে বা থানায় যুদ্ধ করিয়া মরিল, অপরে হতাশ হইয়া স্থান ত্যাগ করিয়া সরিয়া পড়িল।
ইহার মধ্যে কোণ্ডনা-জয়ের কাহিনী এখনও মারাঠাদেশে লোকেরা মুখে মুখে গান করে। শিবাজী তাঁহার মহাকায় মাব্লে সেনাপতি ও বাল্যবন্ধু তানাজী মাল্সরেকে এই দুর্গ আক্রমণ করিতে পাঠাইলেন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে তিনশত বাছা বাছা মাব্লে পদাতিক লইয়া তানাজী অন্ধকার রাত্রে দড়ির সিঁড়ি লাগাইয়া পর্বতের উত্তর-পশ্চিম গা বাহিয়া উপরে উঠিলেন; অসভ্য কোলী-জাতীয় কয়েকজন স্থানীয় লোক তাঁহাকে গুপ্ত পথ দেখাইয়া দিল। দুর্গপ্রাচীরে পৌঁছিয়াই সেখানকার বাদশাহী প্রহরীদের নিহত করিয়া তাঁহারা ভিতরে ঢুকিলেন। কিলাদার উদয়ভান এবং তাঁহার রাজপুত সেনারা দুর্গ রক্ষা করিতেছিল। ‘শত্রু আসিয়াছে’ এই চীৎকার শুনিয়া তাহারা সেদিকে অগ্রসর হইল। কিন্তু শীতের রাত্রে আফিংখোর রাজপুতরা তাড়াতাড়ি শয্যাত্যাগ করিতে পারিল না। ইতিমধ্যে মারাঠারা দুর্গ-প্রাচীরের এক অংশ বেশ দখল করিয়া বসিয়াছে। যখন রাজপুতগণ আসিয়া পৌঁছিল, মারাঠারা “হর হর মহাদেব” শব্দে তাহাদিগকে আক্রমণ করিল। উদয়ভান তানাজীকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান করিলেন। পরস্পরের তরবারির আঘাতে দুই সেনানীই মারা গেলেন। কিন্তু তানাজীর ভাই সূর্য্যাজী সামনে আসিয়া বলিলেন, “সৈন্যগণ। ভাই মারা পড়িয়াছেন, কিন্তু ভয় নাই। আমি তোমাদের নেতা হইব।” নেতার পতনে রাজপুতেরা কিছুক্ষণ হতভম্ব হইয়া রহিল। আর অমনি মারাঠারা আবার রুখিয়া তাহাদের আক্রমণ করিল। ইতিমধ্যে তাহারা দুর্গের দরজা খুলিয়া দেওয়ায় আরও অনেক মারাঠ সৈন্য নীচ হইতে ভাল পথ দিয়া দুর্গে ঢুকিল। অবশেষে এই নিস্ফল যুদ্ধে বারো শত রাজপুত মারা পড়িল, অনেকে পাহাড়ের গা বাহিয়া পলাইতে গিয়া নীচে পড়িয়া প্রাণ হারাইল।