মারাঠী জনসাধারণের ভাষা আড়ম্বরপূন্য, কর্কশ,কেবলমাত্র কাজের উপযোগী। ইহাতে উর্দ্দূর কোমলতা, শব্দবিন্যাসের মারপেঁচ, ভাব প্রকাশের বৈচিত্র্য, ভব্যতা ও আমীরি সুর একেবারেই নাই। মারাঠারা যে স্বাধীনতা, সাম্য ও প্রজাতন্ত্রপ্রিয় তাহার প্রমাণ— তাহাদের ভাষায় ‘আপনি’ অর্থাৎ সম্মানসূচক কোন ডাক ছিল না সকলেই ‘তুমি’।
এইরূপে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দেখা গেল, মহারাষ্ট্র দেশে ভাষায় ধর্ম্মে চিন্তায় জীবনে এক আশ্চর্য একতা ও সাম্যের সৃষ্টি হইয়াছে। শুধু রাষ্ট্রীয় একতার অভাব ছিল; তাহাও পূরণ করিলেন—শিবাজী। তিনিই প্রথমে জাতীয় স্বরাজ্য স্থাপন করিলেন; তিনি দিল্লীর আক্রমণকারীকে স্বদেশ হইতে বিতাড়িত করিবার জন্য যে যুদ্ধের সূচনা করেন, তাহা তাঁহার পুত্রপৌত্রগণ চালাইয়া দেহের রক্তদানে মারাঠা-মিলন গাঁথিয়া তুলিল। অবশেষে পেশোয়াগণের রাজত্বকালে সমগ্র ভারতের রাজরাজেশ্বর হইবার চেষ্টার ফলে যে জাতীয় গৌরব-জ্ঞান, জাতীয় সমৃদ্ধি, জাতীয় উৎসাহ জাগিয়া উঠে তাহা শিবাজীর ব্রত সম্পূর্ণ করিয়া দিল,—কয়েকটি জাত (caste) এক ছাঁচে ঢালা হইয়া রাষ্ট্রসঙ্ঘ (nation) গঠিত হইবার পথে অগ্রসর হইল। ভারতের অন্য কোন প্রদেশে ইহা ঘটে নাই।
কৃষক ও সৈনিক জাত
‘মারাঠা’ বলিতে বাহিরের লোক এই নেশন্ বা জনসঙ্ঘ বোঝে। কিন্তু মহারাষ্ট্রে এই শব্দের অর্থ একটি বিশেষ জাত অর্থাৎ বর্ণ, সমগ্র মহারাষ্ট্রবাসী নেশন্ নহে। এই মারাঠা জাত এবং তাহাদের নিকট কুটুম্ব কুন্বী জাতের অধিকাংশ লোকই কৃষক সৈন্য বা প্রহরীর কাজ করে। ১৯১৯ সালে মারাঠা জাত সংখ্যায় পঞ্চাশ লক্ষ এবং কুন্বীরা পঁচিশ লক্ষ ছিল। এই দুই জাত লইয়া শিবাজীর সৈন্যদল গঠিত হয়—যদিও সেনাপতিদের মধ্যে অনেকেই ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ ছিলেন।
“মারাঠা (অর্থাৎ কৃষক) জাত সরল, খোলামন, স্বাধীনচেতা, উদার ও ভদ্র; সদ্ব্যবহার পাইলে পরকে বিশ্বাস করে; বীর ও বুদ্ধিমান, পূর্ব্বগরিমা স্মরণ করিয়া গর্ব্বোৎফুল্ল। ইহারা মুরগী ও মাংস খায়, মদ ও তাড়ি পান করে (কিন্তু নেশাখোর নহে)। বোম্বাই প্রদেশের রত্নগিরি জেলার মারাঠা জাত হইতে যত লোক সৈন্যদলে ভর্তি হয়, অন্য কোন জাত হইতে তত নহে! অনেকে পুলিস এবং পাইক হরকরা হয়। মারাঠারা কুন্বীর মত শান্ত ভদ্রব্যবহারকারী, মোটেই রাগী নহে, কিন্তু অধিকতর সাহসী ও দয়াদাক্ষিণ্যশালী। তাহারা বেশ মিতব্যয়ী, নম্র, ভদ্র ও ধর্মপ্রাণ। কুন্বীরা এখন সকলেই কৃষক হইয়াছে—তাহারা স্থির, শান্ত, শ্রমী, সুশৃঙ্খল, দেবদেবীভক্ত, এবং চুরি-ডাকাতি বা অন্য অপরাধ হইতে মুক্ত। তাহাদের স্ত্রীলোকগণ পুরুষের মত বলিষ্ঠ এবং কষ্টসহিষ্ণু। ইহাদের মধ্যে বিধবা-বিবাহ প্রচলিত আছে।” (বম্বে গেজেটিয়র)
মারাঠা-চরিত্রের গুণের কথা বলিলাম, এইবার তাহাদের দোষগুলির আলোচনা করা যাক।
মারাঠা চরিত্রের দোষ
মারাঠা-রাজশক্তি বিদেশ-লুণ্ঠনের বলে বঁচিয়া থাকিত। এরূপ দেশের রাজপুরুষেরা নিজের জন্য লুঠ করিতে, অর্থাৎ ঘুষ লইতে কুষ্ঠিত হয় না। প্রভূর প্রবৃত্তি ভৃত্যে দেখা দেয়। শিবাজীর জীবিতকালেও উঁহার ব্রাহ্মণ কর্ম্মচারীরা নির্ণভাবে ঘুষ চাহিত ও আদায় করিত।
মারাঠাদের মধ্যে ব্যবসায়-বুদ্ধি বড় কম, ইহার ফলে তাহাদের রাজত্ব বেশীদিন টেকে নাই। এই জাতির মধ্যে একজনও বড় শ্রেষ্ঠী (ব্যাঙ্কার), বণিক, ব্যবসায়-পরিচালক, এমন কি সর্দ্দার ঠিকাদারেরও উদ্ভব হয় নাই। মারাঠা-রাজশক্তির প্রধান ত্রুটি ছিল—অর্থনীতির ক্ষেত্রে অপারকতা। ইহাদের রাজারা সর্বদাই ঋণগ্রস্ত, নিয়মিত সময়ে ও সুচারুরূপে রাজ্যের ব্যয়-নির্ব্বাহ এবং শাসনযন্ত্র ঠিক এবং দ্রুত পরিচালন করা তাঁহাদের সকলের নিকট অসম্ভব ছিল।
কিন্তু বর্ত্তমান মারাঠারা এক অতুলনীয় সম্পদে ধনী। মাত্র তিন পুরুষ আগে তাহাদের জাতি শত শত যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্মুখীন হইয়াছিল, রাজ্যের দৌত্যকার্য্য ও সন্ধির তর্ক এবং ষড়যন্ত্রজালে লিপ্ত হইয়াছিল, রাজস্ব-চালনা আয়ব্যয় নির্ব্বাহ করিয়াছিল,সাম্রাজ্যের নানা সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা করিতে বাধ্য হইয়াছিল। তাহারা যে-ভারতের ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে, আমরা এখন সেই ভারতেরই অধিবাসী। এই-সব কীর্তির স্মৃতি প্রতি মারাঠার অন্তরে অবর্ণনীয় তেজের সঞ্চার করে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ধীর শ্রমশীলতা, সরল চালচলন, মানব-জীবনের সর্বোচ্চ আদর্শের অনুসরণ করিবার জন্য প্রাণের টান, যাহা উচিত বলিয়া জানি তাহা করিবই—এই দৃঢ়পণ, ত্যাগস্পৃহা, চরিত্রের দৃঢ়তা, এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সাম্যে বিশ্বাস,—এই-সব গুণে মারাঠী মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভারতের অপর কোন জাতি হইতে কম নহে, বরং অনেকস্থলে শ্রেষ্ঠ। আহা! সেই সঙ্গে তাহাদের যদি ইংরাজদের মত অনুষ্ঠানগঠনে ও বন্দোবস্তে দক্ষতা, সকলে মিলিয়া-মিশিয়া কাজ করিবার শক্তি, লোককে চালাইবার ও বশ করিবার স্বাভাবিক ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি, এবং অজেয় বিষয়-বুদ্ধি (common sense) থাকিত, তবে ভারতের ইতিহাস আজ অন্যরূপ হইত।
০২. বাজীর অভ্যুদয়
দ্বিতীয় অধ্যায় – শিবাজীর অভ্যুদয়
ভোঁশলে বংশ
শিবাজীর অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিক মারাঠাদের জাতীয় জীবন-প্রভাত। তিনিই দেশের শক্তিহীন, খ্যাতিহীন বিক্ষিপ্ত মানুষগুলিকে একত্র করিয়া, শক্তি দিয়া রাষ্ট্রসঙ্ঘে গাঁথিয়া, হিন্দুর ইতিহাসে এক নবীন সৃষ্টি রচনা করেন। এটি যে তাঁহার ব্যক্তিগত কীর্ত্তি তাহার প্রমাণ পাই—যখন আমরা তাঁহার আদি-পুরুষদের ইতিহাস এবং তাঁহার পৈত্রিক পুঁজিপাটা খুঁজিয়া দেখি। বিশাল বেগবতী স্রোতস্বতীর মত তাঁহার উদ্ভব অতি ক্ষুদ্র স্থান হইতে, প্রায় অজ্ঞাত তমসাচ্ছন্ন।