শিরাজীর পলায়নের সময়ের নানা আশ্চর্য্য ঘটনা
চতুর-চুড়ামণি শিবাজী দেখিলেন, আগ্রা হইতে মহারাষ্ট্রের পথ দক্ষিণ পশ্চিম মুখে গিয়াছে, সুতরাং সেদিকে সর্ব্বত্রই শত্রু সজাগ হইয়া পাহারা দিবে। কিন্তু উত্তর-পূর্ব্ব দিকের পথে কোন পথিকের উপরই সন্দেহ করিবার কারণ থাকিবে না। সেইজন্য তিনি আগ্রা হইতে বাহির হইয়া প্রথমে উত্তরে,পরে পূব্বদিকে—অর্থাৎ ক্রমেই মহারাষ্ট্র হইতে অধিক দূরে চলিতে লাগিলেন। প্রথম রাত্রিতে ঘোড়া ছুটাইয়া তাঁহারা দ্রুতগতি মপুরায় পৌঁছিলেন, কিন্তু দেখিলেন যে বালক শম্ভুজী অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে; পথ চলিতে একেবারে অক্ষম। অথচ আগ্রার এত নিকটে থাকা শিবাজীর পক্ষে বিশেষ বিপজ্জনক। নিরাজী পণ্ডিত তখন পেশোয়ার শ্যালক তিনজন মথুরাবাসী মারাঠা ব্রাহ্মণকে শিবাজীর আগমন ও দুর্দ্দশার কথা জানাইয়া, সাহায্য ভিক্ষা করিলেন। তাহারাও দেশ ও ধর্ম্মের নামে বাদশাহর শাস্তির ভয় তুচ্ছ করিয়া শম্ভুজীকে নিজ পরিবারমধ্যে আশ্রয় দিতে সম্মত হইলেন। আর তাঁহাদের এক ভাই শিবাজীকে সঙ্গে লইয়া কাশী পর্যন্ত পথ দেখাইয়া চলিলেন।
এই দীর্ঘপথের খরচের জন্য শিবাজী প্রস্তুত হইলেন। সন্ন্যাসীর লাঠির মধ্যে ফুটা করিয়া, তাহা মণি ও মোহর দিয়া পুরিয়া মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন; জুতার মধ্যে কিছু টাকা রাখিলেন, আর একটা বহুমূল্য হীরক এবং অনেকগুলি পদ্মরাগমণি মোম দিয়া ঢাকিয়া তাঁহার অনুচরদের জামার ভিতরে সেলাই করিয়া দিলেন, কিছু কিছু তাহারা মুখে পুরিয়া রাখিল।
মপুরায় পৌঁছিয়া দাড়ি-গোঁফ কামাইয়া, গায়ে ছাই মাখিয়া, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে শিবাজী পথ চলিতে লাগিলেন। নিরাজী ভাল হিন্দী বলিতে পারিতেন। তিনি মোহান্ত সাজিয়া দলের আগে আগে যাইতে লাগিলেন। তিনিই পথের লোকজনদের উত্তর দেন, শিবাজী সামান্য চেলা হইয়া নীরবে তাঁহার পিছু পিছু চলেন। তাঁরা প্রায়ই রাত্রে পথ চলেন, দিনে নির্জ্জন স্থানে বিশ্রাম করেন, প্রত্যহই এক ছদ্মবেশ বদলাইয়া আর এক রকম বেশ ধরেন। তাঁহার চল্লিশ পঞ্চাশজন অনুচর তিনটি পৃথক দলে বিভক্ত হইয়া দূরে দূরে পশ্চাতে আসিতে লাগিল, প্রত্যেক দলেরই ভিন্ন ভিন্ন বেশ।
একবার তিনি ধরা পড়িয়াছিলেন। আলী কূলী নামে বাদশাহর এক ফৌজদার সরকারী হুকুম পাইবার আগেই আগ্রা হইতে নিজ সংবাদ-লেখকের পত্রে শিবাজীর পলায়নের সংবাদ পাইয়া তাহার সীমানার মধ্যে সমস্ত পথিকদের ধরিয়া তল্লাস আরম্ভ করিয়া দিল। শিবাজীও সদলে আটক হইলেন। তিনি দুপুর রাত্রে গোপনে ফৌজদারের কাছে গিয়া বলিলেন, “আমাকে ছাড়িয়া দাও, তোমাকে এখনি লক্ষ টাকা দামের হীরা ও মণি দিব। আর যদি আমাকে বাদশাহর নিকট ধরাইয়া দাও, তবে এসব রত্ন তিনি পাইবেন,তোমার কোনই লাভ হইবে না।” ফৌজদার এই ঘুষ লইয়া তখনি তাঁহাদের ছাড়িয়া দিল।
তারপর গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম-এলাহাবাদের পুণ্যক্ষেত্রে স্নান করিয়া সন্ন্যাসীর বেশে শিবাজী কাশীধামে পৌঁছিলেন। অতি প্রত্যুষে গঙ্গাস্নান, কেশচ্ছেদ প্রভৃতি তীর্থের ক্রিয়াকলাপ শেষ করিয়া তাড়াতাড়ি শহর হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। তাঁহার রওনা হইবার পরই আগ্রা হইতে অশ্বারোহী দূত আসিয়া শিবাজীকে ধরিবার জন্য বাদশাহর আদেশ চারিদিকে প্রচার করিল। অনেক বৎসর পরে সুরতের নাভাজী নামে এক গুজরাতী ব্রাহ্মণ কবিরাজ গল্প করিতেন,—“কাশীতে পাঠ্যাবস্থায় আমি এক ব্রাহ্মণের শিষ্য ছিলাম, গুরু আমাকে বড়ই খাবার কষ্ট দিতেন। একদিন ভোরে অন্ধকার থাকিতে থাকিতেই অন্যদিনের মত নদীর ঘাটে গিয়াছি, এমন সময় একজন লোক আমার হাতের মধ্যে মোহর ও মণি দিয়া দিয়া বলিল, ‘মুঠি ধূলিও না, কিন্তু আমার স্নানাদি তীর্থক্রিয়া যত শীঘ্র পার শেষ করাইয়া দাও।’ আমি তাহার মাথা মুড়াইয়া স্নান করাইয়া দিয়া মন্ত্র পড়িতে লাগিলাম; এমন সময় একদিকে শোরগোল উঠিল যে, পলাতক শিবাজীর খোঁজে আগ্রা হইতে বাদশাহী পুলিশ আসিয়া ঢোল পিটিয়া দিতেছে। তাহার পর পূজার কাজে মন দিয়া যাত্রীটির দিকে ফিরিতেই দেখি, সে ইতিমধ্যে অন্তর্ধান করিয়াছে। মুঠির মধ্যে নয়টি মোহর, নয়টি হোণ, ও নয়টি মণি পাইলাম। গুরুকে কিছু না বলিয়া সটান দেশে ফিরিলাম। ঐ টাকা দিয়া এই বড় বাড়ী কিনিয়াহি।”
কাশী হইতে গয়া পূর্ব্বদিকে; এই তীর্থ করিয়া শিবাজী দক্ষিণ মুখে চলিলেন। পরে গোণ্ডওয়ানা ও গোলকুণ্ডা-রাজ্য পার হইয়া পশ্চিম দিকে ফিরিয়া, বিজাপুরের মধ্য দিয়া নিজ দেশে আসিয়া পৌঁছিলেন। দীর্ঘ পথ হাঁটিতে হাঁটিতে ক্লান্ত হইয়া তিনি একটি টাট্টু (ছোট ঘোড়া) কিনিলেন; দাম দিবার সময় দেখেন, রূপার টাকা নাই, তখন ঘোড়াওয়ালাকে একটি মোহর দিলেন। সে বলিল-“তুমি বুঝি শিবাজী, নহিলে এই টাট্টুর জন্য এত বেশী দাম দিতেছ কেন?” শিবাজী থলি খালি করিয়া সব মোহরগুলি তাকে দিয়া বলিলেন,“চুপ। কথাটি কহিও না।” আর ঘোড়ায় চাপিয়া তাড়াতাড়ি সেখান হইতে সরিয়া পড়িলেন।
পলাতক শিবাজী দেশে পৌঁছিলেন
ক্রমে দাক্ষিণাত্য গোদাবরী-তীরে ইন্দুর-প্রদেশ পার হইয়া এই সন্ন্যাসীর দল মহারাষ্ট্রের সীমানার কাছে এক গ্রামে সন্ধ্যার সময় আসিয়া পৌঁছিল। তাহারা গাঁয়ের মোড়লের স্ত্রী (পাটেলিন্)-এর বাড়ীতে রাত্রির জন্য আশ্রয় চাহিল। ইহার কিছুদিন আগেই আনন্দ রাও-এর অধীনে শিবাজীর সৈন্য আসিয়া এই গ্রামের সব শস্য ও ধন লুট করিয়া লইয়া গিয়াছিল। পাটেলিন্ উত্তর করিল,—“বাড়ী খালি পড়িয়া আছে। শিবাজীর সওয়ার আসিয়া সব শস্য লইয়া গিয়াছে। শিবাজী কয়েদ আছে। সেইখানেই পচিয়া মরুক”, এবং তাঁহার উদ্দেশ্যে কত অভিশম্পাত করিতে লাগিল। শিবাজী হাসিয়া নিরাজীকে ঐ গ্রামের ও তাহার পাটলিনের নাম লিখিয়া লইতে বলিলেন। নিজ রাজধানীতে পৌঁছিবার পর পাটেলিনকে ডাকাইয়া, লুটে যাহা ক্ষতি হইয়াছিল তাহার বহুগুণ অধিক ধন দান করিলেন।