পরনি বাদশাহর হুকুমে আগ্রার কোতোয়াল ফুলাদ খাঁ শিবাজীর বাসার চারিদিকে পাহারা ও তোপ বসাইল; মারাঠারাজ সত্য সত্যই বন্দী হইলেন; তাঁহার বাসা হইতে বাহির হওয়া পর্য্যন্ত বন্ধ হইল।
শিবাজী পলায়নের অদ্ভুত পথ বাহির করিলেন
সর আশায় জলাঞ্জলি দিয়া শিবাজী পুত্রকে বুকে ধরিয়া কান্নাকাটি করিতে লাগিলেন। তাঁহার সঙ্গীরা সান্ত্বনা দিবার অনেক চেষ্টা করিল।
কিন্তু বেশীদিন এইভাবে গেল না। শিবাজীর অদম্য সাহস ও প্রখর বুদ্ধি শীঘ্রই প্রকাশ পাইল। তিনি নিজের মুক্তির পথ নিজেই বাহির করিলেন। প্রথমতঃ, তিনি সকলের কাছে লোক পাঠাইয়া জানাইতে লাগিলেন যে, তিনি বাদশাহর ভক্ত প্রজা, তাঁহার অসন্তোষের ভয়ে কাঁপিতেছেন। অপরাধ-মার্জ্জনালাভের আশায়, বাদশাহর নিকট সুপারিশ করিবার জন্য শিবাজী দরবারের অনেক সভাসদকে অনুরোধ করিলেন। ইতিমধ্যে তিনি নিজ রক্ষী-সৈন্যদলকে দেশে পাঠাইবার অনুমতি চাহিলেন; বাদশাহ ভাবিলেন, ভালই ত, আগ্রায় যত শত্রু কমে। সৈন্যেরা মহারাষ্ট্রে গেল, সেই সঙ্গে শিরাজীর সঙ্গীরাও অনেকে দেশে ফিরিল। শিবাজী এখন একা-তিনি নিজের পলায়নের পথ নিজেই দেখিলেন।
অসুখের ভাণ করিয়া তিনি শয্যায় আশ্রয় লইলেন; ঘর হইতে আর বাহির হন না। ব্যাধি দূর করিবার জন্য ব্রাহ্মণ সাধুসজ্জন ও সভাসদদিগের মধ্যে তিনি প্রত্যহ বড় বড় ঝুড়ি ভরিয়া ফল ও মিঠাই বিতরণ করিতে সুরু করলেন। প্রত্যেক ঝুড়ি বাঁশের বাঁকে ঝুলাইয়া দুইজন করিয়া বাহক বৈকালে বাসাবাড়ী হইতে বাহিরে লইয়া যাইত। কোতোয়ালের প্রহরীরা প্রথমে দিনকতক ঝুড়ি পরীক্ষা করিয়া দেখিত, তাহার পর বিনা পরীক্ষায় যাইতে দিতে লাগিল।
শিবাজী এই সুযোগেরই অপেক্ষা করিতেছিলেন। ১৯এ আগষ্ট বৈকালে তিনি প্রহরীদের বলিয়া পাঠাইলেন যে, তাঁহার অসুখ বাড়িয়াছে, তাহারা যেন তাঁহাকে বিরক্ত না করে। এদিকে ঘরের মধ্যে তাঁহার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা (শাহজীর দাসীপুত্র) হিরাজী ফর্জন্দ,— দেখিতে কতকটা শিবাজীর মতই—শিবাজীর খাটিয়ায় শুইয়া, চাদরে গা-মুখ ঢাকিয়া, শুধু ডান হাত বাহির করিয়া রাখিলেন; তাঁহার এই হাতে শিবাজীর সোনার বালা দেখা যাইতেছিল। আর সন্ধ্যার সময় শিবাজী ও শম্ভুজী দুইটি ঝুড়ির মধ্যে জড়সড় হইয়া শুইয়া রহিলেন, তাঁহাদের উপর বেশ করিয়া পাতা ঢাকা দেওয়া হইল; আর তাহাদের বাঁকের সামনে ও পিছনে কয়েক ঝুড়ি সত্যকার ফল মিঠাই ভরিয়া সানিবন্দী হইয়া বাহকগণ বাসা হইতে বাহির হইল; বাদশাহর প্রহরীরা কোনই উচ্চবাচ্য করিল না, কেন না ইহা ত নিত্যকার ঘটনা।
আগ্রা শহরের বাহিরে পৌঁছিয়া একটি নির্জ্জন স্থানে ঝুড়ি নামাইয়া বাহকগণ মজুরি লইয়া চলিয়া গেল। তাহার পর শিরাজী ও শম্ভুজী ঝুড়ি হইতে বাহির হইয়া সঙ্গে যে দুইটি মারাঠা-অনুচর আসিয়াছিল তাহাদের সাহায্যে তিন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া একটি ছোট গ্রামে প্রবেশ করিলেন। সেখানে তাঁহার ন্যায়াধীশ নিয়াজী রাবজী ঘোড়া লইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। এখানে মারাঠাদের দল দুই ভাগে বিভক্ত হইল। পুত্র শম্ভুজী, নিরাজী, দত্তাজী ত্র্যম্বক (ওয়াকিয়ানবিস্) ও রাঘবমিত্রকে সঙ্গে লইয়া শিবাজী সন্ন্যাসীর বেশ ধরিয়া সারা অঙ্গে ছাই মাখিয়া মথুরার দিকে অগ্রসর হইলেন, বাকী সকলে দাক্ষিণাত্যের পথ ধরিল।
আগ্রায় শিবাজীর পলায়ন প্রকাশ হইল
এদিকে আগ্রায় ১৯ আগস্টের সারারাত্রি এবং পরদিন তিন প্রহর বেলা পর্যন্ত হিরাজী শিবাজীর বিছানায় শুইয়া রহিলেন। প্রাতে প্রহরীয়া আসিয়া জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল,সোনার বালা পরিয়া বন্দী শুইয়া আছেন, চাকরেরা তাঁহার পা টিপিতেছে। বৈকাল তিনটার সময় হিরাজী উঠিয়া নিজ বেশ পরিয়া চাকরটিকে সঙ্গে লইয়া বাসা হইতে বাহির হইয়া গেলেন; দরজায় প্রহরীদের বলিলেন, “শিবাজীর মাথার বেদনা; কাহাকেও তাঁহার ঘরে যাইতে দিও না, আমি ঔষধ আনিতে যাইতেছি।” এইরূপে দুই-তিন ঘন্টা কাটিয়া গেল। তাহার পর প্রহরীরা দেখিল, বাড়ীটা যেন কেমন খালি খালি ঠেকিতেছে; ভিতরে কোন সাড়াশব্দ নাই, কোন নড়াচড়ার চিহ্ন দেখা যাইতেছে না; অন্যদিনের মত বাহিরের লোকজনও কেহ দেখা করিতে আসিতেছে না। ক্রমে তাহাদের সন্দেহ বাড়িল, তাহারা ঘরে ঢুকিল। ঢুকিয়া যাহা দেখিল তাহাতে তাহাদের চক্ষুস্থির,—পাখী উড়িয়াছে, ঘরে জনমানব নাই!!!
তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। তাহারা গিয়া কোতোয়ালকে সংবাদ দিল। ফুলাদ খাঁ কয়েদীর বাসায় খোঁজ করিয়া দেখিয়া বাদশাহকে জানাইল,—“হুজুর। শিবাজী পলাইয়াছে, কিন্তু ইহার জন্য আমাদের কোনই দোষ নাই। রাজা কুঠুরীর মধ্যেই ছিলেন। আমরা ঠিকমত গিয়া দেখিতেছিলাম; তথাপি একেলা অদৃশ্য হইয়া গিয়াছেন। তিনি মাটির মধ্যে ঢুকিলেন, অথবা আকাশে উড়িয়া গেলেন, বা হাঁটিয়া পলাইলেন তাহা জানা গেল না। আমার কাছেই ছিলাম; দেখিতে দেখিতে তিনি আরনাই। কি যাদুবিদ্যায় এমনটা হইল বলিতে পারি না।”
কিন্তু আওরংজীব এসব বাজে কথায় ভুলিবার পাত্র নহেন। অমনি চারিদিকে “ধর ধর” শব্দ উঠিল, রাজ্যমধ্যে পথঘাটের সব চৌকি, পার-ঘাট এবং পর্ব্বতের ঘাটিতে হুকুম পাঠান হইল যেন দাক্ষিণাত্যযাত্রীদের সকলকে ধরিয়া দেখা হয় তাহাদের মধ্যে শিবাজী আছে কি না। এই হুকুম লইয়া দক্ষিণ দিকে কত সওয়ার ছুটিল। আর আগ্রা বা তাহার নিকটে শিবাজীর যত অনুচর ছিল (যেমন ত্র্যম্বক সোনদেব দবীর এবং রঘুনাথ বল্লাল কোর্ডে), তাহাদের ধরিয়া কয়েদ করা হইল। মারের চোটে তাহারা বলিল যে, রামসিংহের সাহায্যে শিবাজী পলাইয়াছেন! বাদশাহ রাগিয়া রামসিংহের দরবারে আসা বন্ধ করিলেন এবং তাঁহার মনসর ও বেতন কাড়িয়া লইলেন।