রাজসভা লোকে গমগম করিতেছে। সভাসদ গণের নানাবর্ণের পোষাক-পরিচ্ছদ এবং বিস্তৃত গালিচা ও কিংখাব দেখিয়া স্থানটাকে রঙ্গীনফুলের বাগান বলিয়া ভ্রম হয়। চারিদিকে ওমরা ও করদ-রাজাদের গা হইতে হীরা মোতি ও নানাপ্রকার মণির আলো ছড়াইয়া পড়িতেছে। বাদশাহ সিংহাসনে বসিয়াছেন।
রামসিংহ এহেন সভায় শিবাজী ও তাঁহার দশজন প্রধান কর্ম্মচারীকে উপস্থিত করিলেন। মারাঠা-রাজার পক্ষ হইতে বাদশাহর পায়ের নিকট থালায় করিয়া দেড় হাজার মোহর নজর, এবং ছয় হাজার টাকা নিসার[১] স্বরূপ উপহার দেওয়া হইল। আওরংজীব সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “আও, শিবাজী রাজা~” শিবাজীকে হাত ধরিয়া বাদশাহর সামনে লইয়া যাওয়া হইল। তিনি তিনবার সালাম করিলেন, বাদশাহ তাহার প্রতিদান করিলেন। তাহার পর বাদশাহর ইঙ্গিতে শিবাজীকে তাঁহার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে লইয়া গিয়া দাঁড় করান হইল। দরবারের কাজ চলিতে লাগিল, যেন সকলেই শিবাজীর কথা ভুলিয়া গেল।
কত আদর-অভ্যর্থনার আশা বুকে ধরিয়া শিবাজী আগ্রা আসিয়া ছিলেন, ইহাই কি তাহার পরিণাম? দরবারে আসিবার আগে হইতেই তাঁহার মনে দুঃখ ও সন্দেহের সঞ্চার হইয়াছিল। প্রথমতঃ, আগ্রার বাহিরে গিয়া কোন বড় ওমরা তাঁহাকে অভ্যর্থনা করেন নাই, রামসিংহ (আড়াই হাজারী) এবং মুখলিস্ খাঁ (দেড় হাজারী)-র মত দুইজন মধ্যম শ্রেণীর ওমরা কিছুদুর অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া রাজধানীতে আনেন। আর, আজ বাদশাহর দর্শন মিলিবার পর তাঁহার কোন উচ্চ উপাধি, বা মূল্যবান উপহার, এমন কি প্রশংসা-বাক্যও লাভ হইল না। শিবাজী দেখিলেন, যেখানে তিনি দাঁড়াইয়া আছেন সেখান হইতে বাদশাহ অনেক দুরে—সম্মুখে সারির পর সারি ওমরার দল দাঁড়াইয়া। তিনি রামসিংহকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন যে তাহার স্থানটি পাঁচ হাজারী মনসবদারদের মধ্যে। তখন তিনি উচ্চ স্বরে বলিয়া উঠিলেন—“কি? আমার সাত বৎসরের বালক পুত্র শম্ভুজী দরবারে না আসিয়াই পাঁচ হাজারী হইয়াছিল। আমার চাকর নেতাজীও পাঁচ হাজারী। আর আমি, এত বিজয়-গৌরবের পর স্বয়ং আগ্রায় আসিয়া শেষে কেবলমাত্র সেই পাঁচ হাজারীই হইলাম।”
তাহার পর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—তাঁহার সামনের ওমরাটি কে? রামসিংহ উত্তর দিলেন—‘মহারাজা যশোবন্ত সিংহ।’ শুনিয়া শিবাজী রাগে চেঁচাইয়া উঠিলেন, “যশোবন্ত! যাহার পিঠ আমার সৈন্যেরা কতবার রণক্ষেত্রে দেখিয়াছে! আমার স্থান তাহারও নীচে? ইহার অর্থ কি?”
সকলের সামনে এইরূপ তীব্র অপমানে জ্বলিয়া উঠিয়া শিবাজী উঁচু গলায় রামসিংহের সঙ্গে তর্ক করিতে লাগিলেন; বলিলেন-“তরবারি দাও, আমি আত্মহত্যা করিব। এ অপমান সহ্য করা যায় না।” শিবাজীর কড়া কথা এবং উত্তেজিত অঙ্গভঙ্গীতে রাজসভায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইল; রামসিংহ মহা ভাবনায় পডিয়া তাঁহাকে ঠাণ্ডা করিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনই ফল হইল না। চারিদিকেই বিদেশী ও অজানা মুখ, কোন বন্ধু বা স্বজন নাই—রুদ্ধ রোষে ফুলিতে ফুলিতে শিবাজী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেলেন। দরবারে একটা হৈ চৈ পড়িয়া গেল। বাদশাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, ব্যাপার কি? চতুর রামসিংহ উত্তর দিলেন,—“বাঘ জঙ্গলী জানোয়ার। তার এখানে গরম লাগিয়া অসুখ হইয়াছে।” পরে বলিলেন,—“মারাঠা-রাজা দক্ষিণী লোক, বাদশাহী সভায় আদব-কায়দা জানেন না।”
সদয় আওরংজীব হুকুম দিলেন, পীড়িত রাজাকে পাশের ঘরে লইয়া গিয়া মুখে গোলাপজল ছিটাইয়া দেওয়া হউক; জ্ঞান হইলে তিনি বাসাবাড়ীতে চলিয়া যাইবেন-দরবার শেষ হইবার জন্য অপেক্ষা করিতে হইবে না।
শিবাজী আগ্রায় নজরবন্দী হইলেন
বাসায় ফিরিয়া আসিয়া শিবাজী প্রকাশ্যভাবে বলিতে সুরু করিলেন যে, বাদশাহ নিজ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছেন; ইহা অপেক্ষা তিনি বরং শিবাজীকে মারিয়া ফেলুন। চরের সাহায্যে সব কথাই আওরংজীবের কাণে পৌঁছিল; শুনিয়া তাঁহার রাগ ও সন্দেহ বৃদ্ধি পাইল। তিনি রামসিংহকে হুকুম দিলেন যে,আগ্রা শহরের দেওয়ালের বাহিরে, জয়পুররাজের জমিতে (অর্থাৎ দুগ হইতে তাজমহলে যাইবার পথের ডান পাশে) শিবাজীকে রাখা হউক এবং যাহাতে তিনি পলাইতে না পারেন, সেজন্য রামসিংহকে দায়ী থাকিতে হইবে। বাদশাহর অসন্তোষের চিহ্ন স্বরূপ শিবাজীকে পুনরায় দরবারে আসিতে নিষেধ করা হইল; তবে বালক শম্ভুজীকে মাঝে মাঝে আসিতে অনুমতি দেওয়া হইল।
শিবাজীর সঙ্গীগণ তাঁহাকে পরামর্শ দিল যে, বাদশাহকে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা জয় করিয়া দিবার লোভ দেখাইয়া তিনি নিজে মুক্তিলাভের চেষ্টা দেখুন। সেইমত দরখাস্ত করা হইল; কিন্তু পড়িয়া বাদশাহ উত্তর দিলেন—“অপেক্ষা কর, তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করিব।” তাহার পর শিবাজী প্রার্থনা করিলেন যে, বাদশাহ যদি তাঁহাকে গোপনে সাক্ষাৎ করিতে দেন তবে রাজ্য-জয়ের একটি সুন্দর উপায় বলিয়া দিবেন। একথা শুনিয়া প্রধান মন্ত্রী জাফর খাঁ (শায়েস্তা খাঁর ভগ্নীপতি, বলিলেন,—“হুজুর, সর্ব্বনাশ। এমন কাজ করিবেন না। শিবাজী পাকা যাদুকর, আকাশে লাফ দিয়া চল্লিশ গজ জমি পার হইয়া শায়েস্তা খাঁর শিবিরে ঢুকিয়াছিল। এখানেও সেইরূপ দাঘাবাজী করিবে।” শিবাজীর আর বাদশাহর সঙ্গে দেখা হইল না।
শিরাজী তখন জাফর খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দাক্ষিণাত্যজয়ের বন্দোবস্তের আলোচনা করিলেন। প্রধান মন্ত্রী বলিলেন, “বেশ ভাল।” কিন্তু তাঁহার স্ত্রী (শায়েস্তা খাঁর ভগিনী) অন্তঃপুর হইতে গোপনে বলিয়া পাঠাইলেন,—“শিবাজী আফজল খাঁকে হত্যা করিয়াছে,শায়েস্তা খাঁর আঙ্গুল কাটিয়া দিয়াছে, তোমাকেও বধ করিবে। শীঘ্র তাহাকে বিদায় কর।” মন্ত্রী তখন “আচ্ছা, আচ্ছা, বাদশাহকে বলিয়া সব সরঞ্জাম দিব”—এই বলিয়া তাড়াতাড়ি কথাবার্ত্তা শেষ করিলেন। শিবাজী বুঝিলেন, তিনি কিছুই করিবেন না।