শিবাজীর আগ্রাযাত্রা—দেশে বন্দোবস্ত ও পথের কথা
যাহা হউক, পাছে মুঘল রাজধানীতে যাইবার পর কোন বিপদ ঘটে, এই আশঙ্কায় শিবাজী রাজ্যরক্ষা ও শাসনকার্য্যের এমন সুন্দর বন্দোবস্ত করিয়া গেলেন যে, স্বদেশে তাঁহার অনুপস্থিতির সময়েও মারাঠাদের কোন ক্ষতি হইবে না; সর্ব্বত্রই তাঁহার কর্ম্মচারিগণ তাঁহার নির্দ্দিষ্ট প্রণালী অনুসারে কাজ চালাইবে, অভ্যস্ত নিয়ম-মত রাজ্যরক্ষা করিবে,—কোনও বিষয়ে নূতন হুকুমের প্রতীক্ষায় প্রভুর মুখ চাহিয়া অসহায় অবস্থায় বসিয়া থাকিতে হইবে না। শিবাজীর মাতা জীজা বাঈ রাজপ্রতিনিধি হইয়া সকলের উপরে রহিলেন। তাঁহার সহকারী হইলেন তিনজন—মোরেশ্বর এ্যম্বক পিংলে পেশোয়া অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রী, নিলো সোনদেব মজমুয়াদার অর্থাৎ হিসাব পরীক্ষক, এবং নেতাজী পালকর সেনাপতি। রাজ্যের সর্ব্বত্র ঘুরিয়া, প্রত্যেক দুর্গ পরীক্ষা করিয়া, সর্ব্বত্র রক্ষার সুবন্দোবস্ত করিয়া, কর্ম্মচারিগণকে দিবারাত্র সতর্ক ও কার্য্য তৎপর থাকিতে এবং তাহার নিয়মাবলী পূর্ণমাত্রায় পালন করিতে বার-বার বলিয়া দিয়া, শিবাজী ৫ই মার্চ ১৬৬৩ তারিখে মাতা ও পরিজনবর্গের নিকট বিদায় লইয়া রাজগড় হইতে রওনা হইলেন। সঙ্গে চলিল—পুত্র শম্ভুজী, কয়েকজন বিশ্বস্ত মন্ত্রী, এবং এক হাজার শরীর-রক্ষী সৈন্য। তাঁহার পথ-খরচের জন্য দাক্ষিণাত্যের রাজকোষ হইতে একলক্ষ টাকা অগ্রিম দেওয়া হইল। ইহার আগেই শিবাজীর দুত-স্বরূপ রঘুনাথ বল্লাল কোর্ডে এবং সোনাজী পন্ত দবীর্ বাদশাহর দরবারে যাত্রা করিয়াছিলেন।
উত্তর-ভারতে যাইবার পথে শিবাজী প্রথমে আওরঙ্গাবাদ শহরে পৌছিলেন। তাঁহার খ্যাতি এবং সৈন্যদের জাঁকজমকপূর্ণ সাজসজ্জার কথা শুনিয়া নগরবাসীরা অগ্রসর হইয়া তাঁহাদের দর্শনলাভের প্রতীক্ষা করিতেছিল। কিন্তু স্থানীয় মুঘল শাসনকর্ত্তা সফ্শিকন্ খাঁ ভাবিলেন ষে, শিবাজী সামান্য জমিদার এবং বুনো মারাঠামাত্র; তিনি অতিথিকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য স্বয়ং অগ্রসর না হইয়া ভ্রাতুষ্পুত্রকে পাঠাইয়া দিয়া জানাইলেন যে শিবাজী যেন তাঁহার কাছারীতে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। এই অপমানসূচক ব্যবহারে শিবাজী অত্যন্ত রাগিয়া, সফ্শিকন্ খাঁর ভাতুষ্পুত্রের কথায় একেবারেই কান না দিয়া, সোজা শহরের মধ্যে নিজের জন্য নির্দ্দিষ্ট বাসাবাড়ীতে উপস্থিত হইলেন; ভাবটা দেখাইলেন যেন ঐ শহরের শাসনকর্ত্তা মানুষ বলিয়া গণ্য হইবার উপযুক্ত নয়। সফ্শিকন্ বুঝিলেন, এ বড় শক্ত লোক; তিনি অমনি নরম হইয়া সরকারী কর্ম্মচারীদের সহিত গিয়া শিবাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন। এইরূপে নিজ মর্য্যাদা সকলের সামনে রক্ষা করিবার পর, শিবাজীর আর রাগ রহিল না। তিনি পরদিন গিয়া সফ্শিকনের আগমনের প্রতিদান, এবং মুঘল কর্ম্মচারিদিগকে ভদ্রতার জন্য আপ্যায়িত করিলেন।
কয়েক দিন তথায় থাকিয়া, শিবাজী আবার উত্তরমুখে চলিলেন। বাদশাহর হুকুম অনুসারে পথে স্থানীয় কর্ম্মচারীরা তাঁহাকে রসদ ও নানা উপহার আনিয়া দিল। এইরূপে তিনি ৯ই মে আগ্রার নিকট পৌঁছিলেন। বাদশাহ তখন আগ্রা শহরে বাস করিতেছেন। যে আট বৎসর শাহজাহান আগ্রা-দুর্গে বন্দীভাবে ছিলেন, আওরংজীব আগ্রায় কখন নিজ মুখ দেখান নাই,—দিল্লীতেই থাকিতেন। ১৬৬৬ সালে ২২এ জানুয়ারি শাহজাহানের মৃত্যুর পরেই তিনি আগ্রার রাজবাড়ীতে প্রথম বার আসিয়া তথায় সমারোহে অভিষেক-ক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
আওরংজীবের সহিত শিবাজীর সাক্ষাৎ
শিবাজী আগ্রায় পৌঁছিবার তিনদিন পরেই চান্দ্র বৎসরের হিসাবে বাদশাহর পঞ্চাশত্তম জন্মদিন; স্থির হইল, জন্মদিনের উৎসব ও আড়ম্বরের মধ্যে শিবাজী বাদশাহকে দর্শন করিবেন, কারণ সেকালে শুভ দিনক্ষণ না দেখিয়া কোন কাজই করা হইত না।
আগ্রা-দুর্গের মধ্যে সারি সারি স্তম্ভ-গঠিত দরবার-গৃহ দেওয়ান-ইআম, আজ জন্মদিনের উৎসবে পরিপাটিরূপে সাজান হইয়াছে। দেওয়াল ও থামগুলি বহুমূল্য রঙীন কিংখাব ও শালে জড়ান, মেঝেতে উৎকৃষ্ট গালিচা বিছান। এখানে সব উচ্চশ্রেণীর আমীরওম্রা ও রাজারা খুব জমকাল পোষাক পরিয়া নিজ নিজ নির্দ্দিষ্ট শ্রেণীতে দাঁড়াইয়া আছেন। দেওয়ান-ই আমের সামনে ও দুইপাশে ঘাসে-ঢাকা নীচু আঙ্গিনায় লাল শালু-মোড়া কাঠের ডাণ্ডার সাহায্যে শামিয়ানা টাঙ্গান হইয়াছে। সারা আঙ্গিনাটি শতরঞ্চ ও চাদর দিয়া ঢাকা—এখানে নিম্নশ্রেণীর হাজার হাজার মনসবদার ও সাধারণ অনুচর দাঁড়াইবার স্থান পাইয়াছে। দেওয়ান-ই-আম গৃহের সম্মুখভাগ ও দুই পাশ খোলা, পিছন দিকটায় দুর্গমধ্যস্থ অন্তঃপুরের দেওয়াল। এই দেওয়ালের মাঝখানে মানুষের চেয়ে উঁচু একটি ছোট বারান্দা বাহির হইয়াছে; তাহাতে বাদশাহর সিংহাসন, পশ্চাতে অন্তঃপুর হইতে আসিবার দরজা-পর্দ্দা দিয়া ঢাকা। আর তাহার সামনে দরবার-গৃহের মেঝেতে থাম হইতে থামে রেলিং দিয়া ঘিরিয়া তিনটি কাটরা বা প্রকোষ্ঠ করা হইয়াছে। প্রথমেই সোনার রেলিং, এখানে মাত্র সর্ব্বোচ্চ শ্রেণীর ওমরার প্রবেশের অধিকার; তাহার পিছনে রূপার রেলিং, এখানে মধ্যম শ্রেণীর মনসবদারদের স্থান; সর্ব্ব পশ্চাতে রং করা কাঠের রেলিং, তাহার মধ্যে সামান্য কর্ম্মচারীদের দাঁড়াইবার ব্যবস্থা। প্রত্যেক কাটরায় একটি স্থানে রেলিং খুলিয়া লোকের যাতায়াতের পথ করা ছিল। হিন্দী-কবি ভূষণ সত্যই বলিয়াছেন, এই জন্মদিন-উৎসবের দরবারে অমরাপুরীতে জ্যোতির্ম্ময় দেবগণ-বেষ্টিত ইন্দ্রের মত আওরংজীব বিরাজ করিতেছিলেন।