শিবাজীর উপর মুসলমান সৈন্যদের আক্রোশ
এই আশাভঙ্গ হওয়াতে মুঘল-সৈন্যদলের মধ্যে মহাগণ্ডগোল উপস্থিত হইল। সকলেই এই পরাজয় ও ক্ষতির জন্য জয়সিংহকে দোষ দিতে লাগিল। দিলির খাঁ আগে হইতেই জয়সিংহকে অমান্য করিতেন। এখন তিনি বলিতে লাগিলেন যে, শিবাজীর বিশ্বাসঘাতকতায় বিজাপুর জয় করা ঘটিল না, শিবাজীকে মারিয়া ফেলিতে হইবে; শিবাজী আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, দ্রুত কুচ করিয়া অগ্রসর হইলে দশ দিনের মধ্যেই ঐ দুর্গ মুঘলদের হাতে আসিবে, এখন কেন তাহা হইল না? ইহার পূর্ব্বেও পুরন্দরের সন্ধির পর দিলির খাঁ অনেকবার জসিংহকে অনুরোধ করিয়াছিলেন, “এই সুযোগে শিবাজীকে খুন করিয়া ফেলুন; অন্ততঃ আমাকে সে কাজটা করিতে অনুমতি দিন। আমি এই পাপের সমস্ত ভার নিজের উপর লইব, কেহই আপনাকে দোষী করিবে না।”
জয়সিংহ দেখিলেন যে, উন্মত্ত মুসলমান সেনানীদের হাত হইতে শিবাজীর প্রাণ রক্ষা করা কঠিন। অমনি পথ হইতে ১১ই জানুয়ারি শিবাজীকে নিজ সৈন্যসহ বিজাপুর-রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশটি আক্রমণ করিতে পাঠাইয়া দিলেন, মুখে বলিলেন যে এইরূপে শত্রুসেনা ভাগ হইয়া যাইবে, মুঘলদিগের উপর তাহাদের সমস্ত আক্রমণটা পড়িবে না। জয়সিংহের পাশ হইতে রওনা হইবার পাঁচদিন পরে শিবাজী পনহালা-দুর্গের কাছে পৌছিলেন, এবং রাত্রি এক প্রহর থাকিতে হঠাৎ দুর্গ আক্রমণ করিলেন। কিন্তু দুর্গের সৈন্যগণ আগেই টের পাইয়া সজাগ ছিল, তাহারা মহাবিক্রমে যুদ্ধ করিল। শিবাজীর পক্ষে এক হাজার মারাঠা হতাহত হইয়া পড়িল। তাহার পর সূর্য্য উঠিল; পর্ব্বতের গা বাহিয়া যে মারাঠারা চড়িতেহিল তাহাদের স্পষ্ট দেখা গেল, এবং তাহাদের উপর ঠিক গুলি ও পাথর আসিয়া পড়িতে লাগিল (১৬ জানুয়ারি)। তখন শিবাজী হার মানিয়া চৌদ্দ ক্রোশ দূরে নিজ দুর্গ খেল্নায় ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু ঐ অঞ্চলে তাঁহার লোকদের লুটপাট বন্ধ করিবার জন্য ছয় হাজার বিজাপুরী সৈন্য এবং দুইজন বড় সেনাপতি সেখানে আবদ্ধ হইয়া রহিলেন।
মারাঠা সৈন্যদলে শিবাজীর পরেই নেতাজী পালকর সর্ব্বপ্রধান অধ্যক্ষ। তাঁহার উপাধি “সেনাপতি” এবং তিনি শিবাজীর বংশের এক কন্যাকে বিবাহ করেন। লোকমুখে তাঁহাকে “দ্বিতীয় শিবাজী” বলা হইত। বিজাপুর হইতে চার লক্ষ হোণ ঘুষ পাইয়া তিনি এই সময় হঠাৎ মুঘলপক্ষ ছাড়িয়া আদিল শাহর সঙ্গে যোগ দিলেন, এবং মুঘল অধীন গ্রাম শহর লুটিতে লাগিলেন। জয়সিংহ আর কি করেন? তিনি পাঁচ হাজারী মনসব, বিস্তৃত জাগীর, এবং নগদ আটত্রিশ হাজার টাকা দিয়া নেতাজীকে আবার নিজের দলে ফিরাইয়া আনিলেন (২০ মার্চ্চ ১৬৬৬)। ইহার পূর্ব্বে চারিদিকে বিপদ ঘনাইয়া আসিতেছে দেখিয়া জয়সিংহ বাদশাহকে লিখিয়াছিলেন যে, এই সময়ে সাক্ষাৎ করিবার জন্য ডাকিলে শিবাজীকে মুঘল-রাজধানীতে পাঠাইয়া দিয়া, তিনি দাক্ষিণাত্যে অনেকটা নিশ্চিত হইতে পারেন। আওরংজীব সম্মত হইলেন। তখন সিংহ অনেক আশা-ভরসা ও স্তোকবাক্য দিয়া শিবাজীকে বাদশাহর দরবারে যাইবার জন্য রাজি করাইলেন।
০৬. শিবাজী ও আওরংজীবের সাক্ষাৎ
ষষ্ঠ অধ্যায় – শিবাজী ও আওরংজীবের সাক্ষাৎ
শিবাজীর আগ্রা যাইবার উদ্দেশ্য
পুরন্দরের সন্ধিতে (জুন ১৬৬৫) শিবাজী এই একটি শর্ত্ত করিয়াছিলেন যে, অন্যান্য করদ রাজার মত তাঁহাকে স্বয়ং গিয়া বাদশাহর দরবারে উপস্থিত থাকিতে হইবে না। তবে দাক্ষিণাত্যে কোন যুদ্ধ বাধিলে তিনি বাদশাহী পক্ষকে সসৈন্য সাহায্য করিবেন। কিন্তু বিজাপুর আক্রমণের পর (জানুয়ারি ১৬৬৬) জয়সিংহ নানা যুক্তি দেখাইয়া শিবাজীকে বুঝাইলেন যে, বাদশাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলে তাঁহার অনেক প্রকার লাভ হইবে। ফন্দিবাজ রাজপুতরা শিবাজীর খুব প্রশংসা করিয়া বলিলেন যে, এরূপ চতুর ও কর্ম্মক্ষম বীরের সঙ্গে আলাপ করিলে তাঁহার গুণে মোহিত হইয়া বাদশাহ হয়ত তাঁহাকে সৈন্য ও অর্থ দিয়া বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা বিজয়ে নিযুক্ত করিবেন, এবং সেই অবসরে শিবাজী নিজামশাহী অর্থাৎ আহমদ-নগরের লুপ্ত রাজ্যের বাকী প্রদেশগুলি দখল করিয়া তাঁহার অধিকার নিষ্কন্টক ও স্থায়ী করিতে পারিবেন। এ পর্য্যন্ত কোন মুঘল সেনাপতিই বিজাপুরকে কাবু করিতে পারেন নাই, এমন কি স্বয়ং আওরংজীর যখন যুবরাজ, তখন তিনিও বিফল হইয়াছিলেন। এ কাজ কেবল শিবাজীর পক্ষেই সম্ভব।
শিবাজীরও কয়েকটি প্রার্থনা ছিল; বাদশাহের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহাকে হাত করিতে না পারিলে তাহা পূর্ণ হইবার সম্ভবনা নাই। যেমন, জঞ্জিরার জলবেষ্টিত দুর্গ দখলে না আসিলে শিবাজীর কোঁকনরাজ্য সম্পূর্ণ সুরক্ষিত হয় না; অথচ উহার হাব্শী মালিক সিদ্দি শিবাজীর হস্তে দুর্গটি সমর্পণ করিতে একেবারে অসম্মত; শিবাজীও তাহা অধিকার করিতে গিয়া বার-বার পরাস্ত হইয়াছেন। সিদ্দি এখন বাদশাহর অধীন হইয়াছে, তাঁহার ভয়-ভরসা রাখে; সুতরাং বাদশাহর হুকুম পাইলে সে ঐ দুর্গ শিবাজীকে দিতে বাধ্য হইবে। এ বিষয়ে দিল্লীতে দরখাস্ত পাঠাইয়া শিবাজী কোনই ফল পান নাই। স্বয়ং সাক্ষাৎ করিলে কার্য্যসিদ্ধির সম্ভাবনা।
কিন্তু দিল্লীতে যাইবার কথায় প্রথমে শিবাজীর ও তাঁহার আত্মীয়স্বজনের মনে মহা ভাবনা উপস্থিত হইল। একে ত তিনি বনজঙ্গলে ও গ্রামে প্রতিপালিত ও বর্দ্ধিত, কখন নগর বা রাজসভা দেখেন নাই। তাহার উপর, তাঁহাদের চক্ষে যবন বাদশাহ রাবণের অবতার, হাতে পাইয়া আওরংজীব যদি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া শিবাজীকে বন্দী করেন বা মারিয়া ফেলিবার হুকুম দেন, তখন কি হইবে? কিন্তু জয়সিংহ কঠিন শপথ করিয়া বলিলেন যে, বাদশাহ সত্যবাদী, এবং আশ্বাস দিলেন যে, তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র কুমার রামসিংহ দরবারে থাকিয়া শিবাজীর রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন। শিবাজী দেখিলেন, দিল্লীতে গেলে মোটর উপর ভয় অপেক্ষা লাভের আশাই বেশী।