শিবাজী মুঘলরাজের বাধ্যতা স্বীকার করিলেন
দিলির খাঁ প্রাণপণ পরিশ্রম এবং রক্তপাত করিয়া পুরন্দরের অনেক অংশ দখল করিয়াছেন, আর এদিকে শিবাজী আসিয়া চুপ করিয়া দুর্গটি জয়সিংহের হাতে হাড়িয়া দিয়া খাঁকে গৌরব হইতে বঞ্চিত করিলেন। তিনি রাগিয়া বলিলেন যে, সন্ধিতে রাজি হইবেন না, শেষ অবধি মারাঠাদের ধ্বংস করিবেন। সুতরাং জয়সিংহ পরদিন (১২ই জুন) শিবাজীকে হাতীতে চড়াইয়া নিজ কর্ম্মচারী রাজা রায়সিংহ শিশোদিয়ার সহিত দিলির খাঁর নিকট পাঠাইয়া দিলেন। এই নম্রতায় দিলির খাঁ আপ্যায়িত হইলেন। তিনি শিবাজীকে নানা উপহার দিয়া সঙ্গে করিয়া জয়সিংহের তাঁবুতে ফিরাইয়া আনিয়া তাঁহার হাত ধরিয়া রাজপুত রাজার হাতে সঁপিয়া দিলেন। মুঘল সৈন্যগণ হাতীর উপর শিবাজীকে দেখিয়া বুঝিল যে, সত্যসত্যই তাহাদের সম্পূর্ণ জয় হইয়াছে।
তাহার পর জয়সিংহ শিবাজীকে খেলাৎ পরাইয়া তাঁহার কোমরে নিজের তরবারি বাঁধিয়া দিলেন, কারণ শিবাজী সন্ধি করিবার জন্য নিরস্ত্র হইয়া আসিয়াছিলেন। তিনি ভদ্রতার খাতিরে কিছুক্ষণ তরবারিটা পরিয়া পরে কোমর হইতে খুলিয়া জয়সিংহের সম্মুখে রাখিয়া বলিলেন, “আমি বাদশাহর বাধ্য কিন্তু অস্ত্রহীন দাস হইয়া তাঁহার কাজ করিব।”
এইদিন মারাঠারা পুরন্দর-দুর্গ ছাড়িয়া দিল; তাহাদের চারি হাজার সৈন্য এবং তিন হাজার স্ত্রীলোক বালক ও চাকর বাহির হইয়া চলিয়া গেল, কিন্তু সমস্ত অস্ত্র গোলা বারুদ ও সম্পত্তি বাদশাহর জব্ৎ হইল। অপরাপর দুর্গ সমর্পণ করিবার জন্য শিবাজী মুঘল-কর্ম্মচারীদের সহিত নিজ চাকর পাঠাইয়া দিলেন। ১৪ই জুন, জয়সিংহের নিকট হইতে একটি হাতী ও দুইটি ঘোড়া উপহার পাইয়া শিবাজী বিদায় লইলেন। ১৮ই তারিখে তাঁহার পুত্র শম্ভুজী রাজগড় হইতে আসিয়া জয়সিংহের শিবিরে পৌঁছিলেন।
এইরূপে জয়সিংহ আশ্চর্য্য জয়লাভ করিলেন।
বিজাপুর-আক্রমণে শিবাজীর সহায়তা ও কীর্ত্তি
পুরন্দরের সন্ধির শর্ত্তগুলি জানিয়া এবং শিবাজী নিজ প্রতিজ্ঞা পূর্ণ মাত্রায় পালন করিয়াছেন এই সংবাদ পাইয়া, বাদশাহ অত্যন্ত তুষ্ট হইয়া সব প্রার্থনা মঞ্জুর করিলেন এবং নিজ পাঞ্জা-অঙ্কিত (অর্থাৎ হাতের আঙ্গুলগুলি সিন্দুরে ডুবাইয়া কাগজের উপর ছাপ দেওয়া) এক ফর্ম্মান্ (বা বাদশাহর নিজের জবানীতে লিখিত ও সহি করা পত্র) এবং একপ্রস্থ খেলাৎ শিবাজীর জন্য পাঠাইয়া দিলেন। এগুলি ৩০এ সেপ্টেম্বর জয়সিংহের শিবিরের নিকট পৌছিল। শিবাজী জয়সিংহের আহ্বানে কয়েক মাইল হাঁটিয়া অগ্রসর হইয়া বাদশাহী ফর্ম্মানকে পথে অভ্যর্থনা করিলেন এবং পত্রখানি মাথার উপর ধরিলেন। (ইহাই সে যুগের প্রথা ছিল।) সন্ধির পর হইতে এই সাড়ে তিন মাস শিবাজী অস্ত্রধারণ ত্যাগ করিয়াছিলেন, কারণ তিনি বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া অপরাধী হইয়াছেন, যতক্ষণ পর্য্যন্ত বাদশাহর ক্ষমা না পাওয়া যায় ততক্ষণ জেলখানার কয়েদীর মত তাঁহাকে নিরস্ত্র থাকিতে হইবে। এখন ফর্ম্মান পাইবামাত্র জয়সিংহ তাঁহাকে জোর করিয়া নিজের একখানি মণিখচিত তরবারি এবং ছোরা পরাইয়া দিলেন।—যেন শিবাজীর বিদ্রোহের প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হইল।
ইহার পর জয়সিংহ নিজ বিজয়ী সেনা লইয়া বিজাপুর-রাজ্য আক্রমণ করিবেন। কথা ছিল, শিবাজী নিজ পুত্রের মন্সবের দুই হাজার অশ্বারোহী এবং অতিরিক্ত সাত হাজার মাব্লে পদাতিক লইয়া স্বয়ং জয়সিংহের সহায়তা করিবেন। তজ্জন্য তাঁহাকে দুই লক্ষ টাকা অগ্রিম দেওয়া হইল। অবশেষে ২০ নবেম্বর ১৬৬৫ জয়সিংহ বিজাপুর অভিযানে রওনা হইলেন। শিবাজী এবং তাহার সেনাপতি নেতাজী পালকরের অধীনে নয় হাজার মারাঠা-সৈন্য মুঘলদলের মধ্যবিভাগের বাম পাশে স্থান পাইল।
যাইতে যাইতে শিবাজীর ডাকে বিনাযুদ্ধে, বিজাপুরের অধীন কয়েকটি দুর্গ পাওয়া গেল (যথা—ফল্টন্, থাথ্বড়া, খাটাব এবং মঙ্গলভিড়ে)। এই শেষ স্থান হইতে বিজাপুর শহর বাহান্ন মাইল দক্ষিণে। ইহার অর্দ্ধেক পথ পার হইতেই বিজাপুরী সৈন্যদল মুঘলদের গতিরোধ করিয়া দাঁড়াইল। কয়েক বার অতি ভীষণ যুদ্ধ হইল। শিবাজী ও নেতাজী প্রাণপণে মুঘলপক্ষে লড়িলেন, আর শত্রুদের দলে শিবাজীর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ব্যঙ্কাজী বীরত্ব দেখাইলেন। একদিন শিবাজী ও জয়সিংহের পুত্র কীরত সিংহ এক হাতীতে চড়িয়া মুঘল-অগ্রবাহিনী সৈন্য লইয়া বিজাপুরীদল ভেদ করিলেন, আর একদিন নেতাজী অদম্য সাহসে মুঘল-সৈন্যের ফিরিবার সময় পশ্চাদ্ভাগ শত্রু-আক্রমণ হইতে রক্ষা করিলেন।
এইরূপে অগ্রসর হইয়া ২৯এ ডিসেম্বর জয়সিংহ বিজাপুর-দুর্গের দশ মাইল উত্তরে পৌঁছিলেন। কিন্তু এখানে তাঁহার গতিরোধ হইল, এখান হইতে সাত দিন পরে তাঁহাকে বাধ্য হইয়া ফিরিতে হইল। বিজাপুর-রাজসভার কর্ম্মচারী ও ওমরাহদের মধ্যে ঝগড়ায় সুযোগে তিনি তাহাদের অনেককে ঘুষ দিয়া হাত করিয়াছিলেন, সুতরাং এই সময় রাজধানী হঠাৎ আক্রমণ করিলে মদ্যপায়ী অকর্ম্মণ্য যুবক রাজা কোনই বাধা দিতে পারিবেন না, বিনা অবরোধে বিজাপুর-দুর্গ অধিকার করা যাইবে এই আশায় জয়সিংহ বড় বড় তোপ এবং দুর্গজয়ের অন্যান্য উপকরণ সঙ্গে আনেন নাই। কিন্তু কাছে পৌঁছিয়া তিনি শুনিলেন যে, আদিল শাহর বীর সেনানীগণ দুর্গরক্ষার সমস্ত জোগাড় করিয়া, বিজাপুরের চারিদিকে সাত মাইল পর্য্যন্ত গাছ কাটিয়া জলাশয় শুকাইয়া গ্রাম ক্ষেত উৎসন্ন করিয়া মুঘলদের অগ্রসর হইবার পথ রোধ করিয়াছেন। আর একদল বিজাপুরী সৈন্য তাঁহার পশ্চাতে গিয়া বাদশাহী প্রদেশে প্রবেশ করিয়া লুঠ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তখন জয়সিংহ হতাশ হইয়া ৫ই জানুয়ারি ১৬৬৬, পশ্চাৎ ফিরিলেন, এবং ক্রমে নিজ সীমানায় পরেণ্ডা দুর্গের কাছে পৌঁছিলেন। এইরূপে বিজাপুর-অভিযান সম্পূর্ণ বিফল হইল।