জয়সিংহ পুণায় পৌঁছিবার আগেই শিবাজী ক্রমাগত তাঁহার কাছে ব্রাহ্মণ-দূত ও চিঠি পাঠাইতেছিলেন, কিন্তু জয়সিংহ তাহার কোন উত্তর দেন নাই, কারণ তিনি জানিতেন যে, যতক্ষণ শিবাজীকে বাহুবলে জব্দ করা না যাইবে ততক্ষণ তিনি সত্যসত্যই বশ মানিবেন না। কিন্তু ২০এ মে শিবাজীর পণ্ডিত রাও (অর্থাৎ দানাধ্যক্ষ) রঘুনাথ বল্লাল আসিয়া গোপনে জয়সিংহকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি পাইলে সন্ধি করিতে প্রস্তুত?” মুঘল-প্রতিনিধি উত্তর করিলেন,“শিরাজী স্বয়ং আসিয়া বিনা শর্ত্তে আত্মসমর্পণ করিবেন, তাহার পর তাঁহার প্রতি বাদশাহর অনুগ্রহ দেখান হইবে।”
শিবাজী-জয়সিংহের সাক্ষাৎ
এই কথা শুনিয়া শিবাজী জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন যে,তাঁহার পুত্র শম্ভুজী আসিয়া বশ্যতা স্বীকার করিলে চলিবে কি? জয়সিংহ উত্তর দিলেন, “না, শিবাজীকে নিজে আসিতে হইবে।” অবশেষে শিবাজী চাহিলেন যে, তিনি সাক্ষাৎ করিতে আসিবার পর সন্ধি হউক বা না হউক, তাঁহাকে নিরাপদে ফিরিয়া যাইতে দেওয়া হইবে বলিয়া জয়সিংহ ধর্ম্ম-শপথ করুন। জয়সিংহ তাহাই করিলেন এবং বলিয়া পাঠাইলেন, শিবাজী যেন অতি গোপনে আসেন, কারণ বাদশাহ রাগিয়া আজ্ঞা দিয়াছেন যে, তাঁহার সহিত সন্ধির কোন কথাবার্ত্তা না বলিয়া নির্ম্মম যুদ্ধ চালাইতে হইবে।
এই বন্দোবস্ত করিয়া ৯ই জুন রঘুনাথ পণ্ডিত নিজ প্রভুর নিকট ফিরিলেন। ১১ই তারিখে বেলা এক প্রহর হইয়াছে, জয়সিংহ নিজ শিবিরে দরবার করিতেছেন, এমন সময় রঘুনাথ আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, শিবাজী শুধু ছয়জন ব্রাহ্মণ সঙ্গে লইয়া পালকী করিয়া অতি নিকটে পৌঁছিয়াছেন। জয়সিংহ তৎক্ষণাৎ তাঁহার মুন্সী উদয়রাজ এবং জ্ঞাতি উগ্রসেন কাছোয়াকে শিবাজীর নিকট পাঠাইয়া দিয়া জানাইলেন, “যদি আপনার সব দুর্গগুলি সমর্পণ করিতে প্রস্তুত থাকেন তবে আসুন, নচেৎ ঐখান হইতেই ফিরিয়া যান।” শিবাজী “আচ্ছা! আচ্ছা!” বলিয়া উহাদের সঙ্গে আসিলেন। শিবির-দ্বারে পৌঁছিলে, জয়সিংহের সর্ব্বপ্রধান সৈনিক কর্ম্মচারী বখ্শী তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিয়া ভিতরে আনিলেন। রাজপুত রাজা স্বয়ং কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া শিবাজীকে আলিঙ্গন করিলেন এবং হাতে ধরিয়া নিজের পাশে গদীর উপর বসাইলেন। তাঁহার রাজপত রক্ষিগণ তরবার ও বল্লম হাতে করিয়া চারিদিকে সতর্ক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, কি জানি যদি বা আবার আফজল খাঁর মত কাণ্ড হয়!
চতুর জয়সিংহ শিবাজীকে শিক্ষা দিবার জন্য একটি অভিনয়ের বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন। পূর্ব্বদিন তিনি দিলির খাঁ ও কীরত সিংহকে হুকুম দিয়াছিলেন যে, তাঁহার তাম্বু হইতে সঙ্কেত-চিহ্ন দেখিলেই তাঁহারা মুর্চা হইতে ছুটিয়া অগ্রসর হইয়া পুরন্দরের খড়কালা নামক অংশ দখল করিবেন। শিবাজী পৌঁছামাত্র জয়সিংহ সেই সঙ্কেত করিলেন, আর মুঘলেরা লড়িয়া ঐ স্থানটি দখল করিল, আশীজন মারাঠা মারা গেল, আরও অনেক জখম হইল। এই যুদ্ধ জয়সিংহের তাম্বুর ভিতর হইতে পরিষ্কার দেখা যাইতে লাগিল। শিবাজী ঘটনাটা কি তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লইয়া বলিলেন, “আর বৃথা আমার লোকহত্যা করিবেন না, যুদ্ধ বন্ধ করুন, আমি এখনই পুরন্দর ছাড়িয়া দিতেছি।” তখন জয়সিংহ তাঁহার মীরতুজুক বাজীবেগকে পাঠাইয়া দিলির খাঁকে রণে ক্ষান্ত হইতে হুকুম দিলেন; সেই সঙ্গে শিবাজীও নিজ কর্ম্মচারী পাঠাইয়া মারাঠা দুর্গস্বামীকে পুরন্দর সমর্পণ করিতে বলিলেন। দুর্গবাসী জিনিসপত্র গুছাইতে একদিন সময় চাহিল।
পুন্দরের সন্ধির শর্ত
শিবাজী বিছানা আসবাবপত্র কিছুই সঙ্গে না লইয়া একেবারে খালি হাতে আসিয়াছিলেন। সেজন্য জয়সিংহ তাঁহাকে অতিথি করিয়া নিজ দরবার-তাম্বুতে বাসা দিলেন। দুপুর রাত্রি পর্য্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধির শর্ত্ত লইয়া দর কষাকষি চলিতে লাগিল। জয়সিংহ প্রথমে কিছুই ছাড়িবেন না, অবশেষে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর স্থির হইল যে, শিবাজীর তেইশটি দুর্গ এবং তদসংলগ্ন সমস্ত জমি (যাহার বার্ষিক খাজনা চারিলক্ষ হোণ অর্থাৎ বিশ লক্ষ টাকা) বাদশাহ পাইবেন, আর বারোটি দুর্গ (এবং তদসংলগ্ন এক লক্ষ হোণের জমি) শিবাজীর থাকিবে। কিন্তু শিবাজী বাদশাহর প্রজা বলিয়া নিজেকে মানিবেন এবং তাঁহার অধীনে কার্য্য করিবেন।
তবে এক বিষয়ে শিবাজীকে অপমান হইতে রক্ষা করা হইল। তাঁহাকে নিজে মন্সবদার হইয়া সৈন্য লইয়া বাদশাহর বা দাক্ষিণাত্যের রাজপ্রতিনিধির দরবারে হাজির হইতে হইবে না, তাঁহার পুত্র পাঁচ হাজারী জাগীরের অনুযায়ী (প্রকৃতপক্ষে দুই হাজার) সৈন্য লইয়া উপস্থিত থাকিবেন। উদয়পুরের মহারাণাকেও এই অনুগ্রহ দেখান হইত। জয়সিংহ জানিতেন যে, বেশী কড়াকড়ি করিলে শিবাজী হতাশ হইয়া বিজাপুরের সঙ্গে যোগ দিবেন।
পরস্পরের সন্ধিতে আর একটি গোপনীয় শর্ত্ত ছিল। কোঁকন অর্থাৎ পশ্চিমঘাট এবং সমুদ্রের মধ্যবর্ত্তী অতি লম্বা সরু কিন্তু ধনজনপূর্ণ প্রদেশ বিজাপুরের অধীন ছিল। শীঘ্রই বাদশাহ বিজাপুর-রাজ্য আক্রমণ করিবেন। তখন শিবাজী বিজাপুরের হাত হইতে তলভূমি (তল্-কোঁকন বা বিজাপুরী পাইন্-ঘাট)-র চারি সরু হোণ আয়ের জমি এবং অধিত্যকা (অর্থাৎ বিজাপুরী বালাঘাট -এর পাঁচলক্ষ হোণ আয়ের জমি নিজ সৈন্য দ্বারা কাড়িয়া লইবেন, এবং বাদশাহ ইহাতে তাঁহার অধিকার স্বীকার করিবেন, কিন্তু তজ্জন্য শিবাজী তাঁহাকে চল্লিশ লক্ষ হোণ (অর্থাৎ দুই কোটি টাকা) তের কিস্তিতে সেলামী দিবেন। এইরূপে জয়সিংহের কুটনীতির ফলে শিবাজী ও আদিল শাহর মধ্যে স্থায়ী কলহের বীজ রোপিত হইল।