পুণায় থাকিবার সময় আবশ্যক মত নানা স্থানে অল্প অল্প সৈন্য দিয়া থানা বসাইয়া জয়সিংহ নিজ পথঘাট রক্ষা করিলেন; তাহার পর ২৩ মার্চ্চ রওনা হইয়া ৩০এ তারিখে পুরন্দরের সামনে আসিয়া পৌঁছিলেন। পরদিন হইতে রীতিমত দুর্গ অবরোধ আরম্ভ হইল। বিভিন্ন বাদশাহী সেনাপতিরা নিজ দলবল সহিত পুরন্দরের নানা দিকে আড্ডা করিয়া মুর্চা খুঁড়িয়া দুর্গের উপর তোপ দাগিবার চেষ্টা করিলেন। দিন-দশের মধ্যেই সৈন্যদের অক্লান্ত চেষ্টায় এবং জয়সিংহের নিয়ত তত্ত্বাবধান এবং উৎসাহদানের ফলে তিনটি খুব বড় কামান একটি উচ্চ পাহাড়ের উপর টানিয়া তোলা হইল এবং রুদ্রমালের বুরুজের উপর ভারি ভারি গোলাবর্ষণ শুরু হইল। তাহার ফলে বুরুজের সামনের দেওয়াল ভাঙ্গিয়া গিয়া একটি প্রবেশের পথ দেখা দিল।
রুদ্রমাল ও বুরুজ জয় হইল
১৩ই এপ্রিল দুপুর বেলা দিলির খাঁ হঠাৎ আক্রমণ করিয়া এই বুরুজটি দখল করিলেন; মারাঠারা হটিয়া গিয়া মধ্যের একটি দেওয়াল-ঘেরা স্থানে আশ্রয় হইল। পরদিন বৈকালে মুঘল ও রাজপুতদের বন্দুকের গুলিতে অতিষ্ঠ হইয়া মারাঠারা সমস্ত রুদ্রমাল ছাড়িয়া দিল। জয়সিংহ তাহাদের প্রাণদান করিলেন। এবং তাহাদের নেতাদের সম্মানসূচক পোষাক দিয়া বাড়ী ফিরিতে অনুমতি দিলেন।
তাহার পর (২৫ এপ্রিল) দায়ূদ খাঁর অধীনে ছয় হাজার সৈন্য দিয়া তাঁহাকে মহারাষ্ট্রের চারিদিকে গ্রাম লুটিতে পাঠাইলেন। আর কুতবুদ্দীন খাঁ এবং লোদী খাঁকেও নিজ নিজ থানা হইতে বাহির হইয়া নিকটের গ্রাম লুটিতে এবং গরুবাছুর কৃষক বন্দী করিতে আজ্ঞা দিলেন। ইহার ফলে শিবাজীর প্রজাদের সমূহ ক্ষতি ও তাঁহার দেশের স্থায়ী অনিষ্ট হইল।
সম্মুখে এবং চারি পাশে এইরূপ বিপদ দেখিয়া মারাঠারা পুরন্দর অবরোধকারীদের তাড়াইয়া দিবার নানা চেষ্টা করিল। মুঘল-প্রদেশের স্থানে স্থানে দ্রুতবেগে আক্রমণ করিল। কিন্তু জয়সিংহ পুরন্দর হইতে নড়িলেন না, দূরে আক্রান্ত স্থানগুলিকে রক্ষা করিবার জন্য কিছু কিছু অশ্বারোহী পাঠাইলেন মাত্র। মুঘলদের অনেক ক্ষতি হইল বটে, কিন্তু আসল কাজ পুরন্দর-অবরোধের কোন বাধা হইল না,সেখানে রসদ আসিতে লাগিল এবং শিবির ও সৈন্যদল নিরাপদ রহিল।
বজ্রগড় জিতিবার পরই দিলির খাঁ সেখান হইতে ঐ লম্বা পর্ব্বত রাহিয়া পশ্চিম দিকে আসিয়া পুরন্দরের উত্তর পূর্ব কোণের উচ্চ বুরুজের (নাম ‘খড়কালা’র) কাছে পৌঁছিয়া নীচের দুর্গের (মাচীর) উপর গোলা ফেলিতে লাগিলেন। মারাঠারা দুই হইবার রাত্রে বাহির হইয়া আসিয়া এইখানের মুর্চাগুলি আক্রমণ করিল বটে, কিন্তু তাহাদের পরাস্ত হইয়া ফিরিতে হইল।
ক্রমে ক্রমে মুঘলদের মুর্চা পুরন্দরের “সাদা বুরুজ”দুটির নিম্নে আসিয়া পেীছিল; কিন্তু তখনও দেওয়াল খাড়া ছিল, তাহার উপর হইতে মারাঠারা নীচে জ্বলন্ত আলকাতরা, বারুদের থলি, বোমা এবং পাথর ফেলিয়া অবরোধকারীদের আর অগ্রসর হইতে দিল না। তখন সিংহ একটি উচু কাঠের রথ প্রস্তুত করিয়া সাদা বুরুজের সামনে খাড়া করিলেন (৩০এ মে); তাহার উপর হইতে কামান দাগা হইবে, এবং বন্দুক ছুঁড়িয়া দেওয়াল হইতে রক্ষাকারীদের হটাইয়া দেওয়া হইবে, আর শত্রুদের গুলি রোধ করিবার জন্য রথের সম্মুখে কাঠের আবরণ থাকিবে।
এই রথ সম্পূর্ণ হইবার আগেই, সন্ধ্যার দুঘন্টা মাত্র বাকী আছে এমন সময়, দিলির খাঁকে না জানাইয়াই রুহিলা সৈন্যদল “সাদা বুরুজ” আক্রমণ করিল। শত্রুরা তাহাদের মারিতে লাগিল, কিন্তু শীঘ্রই মুঘলপক্ষ হইতে আরও লোক আসায় ভীষণ যুদ্ধের পর মুঘলদের জয় হইল, তাহারা সাদা বুরুজ দখল করিল, মারাঠারা “কাল বুরুজের” পিছনে হটিয়া গিয়া বোমা, পাথর ইত্যাদি ছুঁড়িতে লাগিল। কিন্তু মুঘলেরা নড়িল না। তাহার দুইদিন পরে, মুঘল-তোপের আওয়াজ সহ্য করিতে না পারিয়া মারাঠারা কাল বুরুজও ছাড়িয়া দিল। এইরূপে ক্রমে পাঁচটি বুরুজ এবং একটি কাঠগড়া (ষ্টকেড্) বাদশাহী সৈন্যদের হাতে পড়িল।
পুরন্দরে মারাঠাদের লোকনাশ ও বিপদ
এখন আর পুরন্দর রক্ষা করা অসম্ভব। ইহার পূর্ব্বেই একদিন দুর্গস্বামী মুরার বাজী প্রভু (কায়স্থ) নিজ মাব্লে পদাতিক লইয়া দিলির খাঁর পাঠানদের উপর মরিয়া হইয়া পড়িয়াছিলেন। দুই পক্ষে অনেকে হতাহত হইল; মুরার বাজীর তরবারির সম্মুখে কেহ দাঁড়াইতে পারিল না,অবশেষে ষাটজন মাত্র লোক সঙ্গে লইয়া তিনি দিলির খাঁকে আক্রমণ করিলেন। দিলির তাঁহার বীরত্বে মুগ্ধ হইয়া চেঁচাইয়া বলিলেন, “সৈন্যগণ। উহাকে কেহ মারিও না। আর মুরার। তুমি ধরা দাও, তোমাকে উচ্চ পদ দিব।” কিন্তু মুরার থামিলেন না, তখন দিলির তাঁহাকে তীর দিয়া বধ করিলেন। মুরারের সঙ্গে তিনশত মাব্লে ধরাশায়ী হইল; পাঠান-পক্ষে পাঁচশতজন। কিন্তু তবুও মারাঠাদের সাহস কমিল না; তাহারা বলিতে লাগিল, “এক মুরার বাজী মারা গিয়েছে ত কি হইল? আমরাও তাহার সমান, যতক্ষণ প্রাণ থাকিবে যুদ্ধ চালাইব।”
কিন্তু জয়সিংহের অধ্যবসায় এবং দুইমাস অবিশ্রান্ত যুদ্ধের ফলে পুরন্দর-রক্ষীদের অনেক বলক্ষয় হইল। যখন রুদ্রমল গেল, পাঁচটি বুরুজ ও একটি কাঠগড়া গেল, তখন সমগ্র দুর্গটি হস্তচ্যুত হইবার দিন ঘনাইয়া আসিল। শিবাজী দেখিলেন, এখন সন্ধি না করিলে মুঘলেরা বলে পুরন্দর অধিকার করিবে এবং সেখানে যে সমস্ত মারাঠা কর্ম্মচারী আশ্রয় লইয়াছিল তাহাদের বধ এবং তাহাদের স্ত্রীলোকদের ধর্ম্মনাশ করিবে। আর বাহিরেও দায়ুদ খাঁ প্রতিদিন তাঁহার গ্রাম ধ্বংস করিতেছেন।