এই ষাট বৎসর বয়সের প্রবীণ নেতা আজ দক্ষিণাত্যের এক জাগীরদারের পুত্রকে দমন করিতে আসিলেন। কিন্তু তাঁহার ভাবনার অন্ত ছিল না। কি মুঘল, কি বিজাপুরী সেনানী, কেহই শিবাজীকে এ পর্য্যত পরাস্ত করিতে পারেন নাই; শায়েস্তা খাঁ, যশোবন্ত পর্য্যন্ত হারিয়া গিয়াছেন। তাহার পর, উত্তর-ভারত হইতে প্রবল সৈন্যদল আসিলে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার সুলতানদ্বয় মুঘলের ভয়ে শিবাজীর সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, সুতরাং জয়সিংহকে সেদিকেও দৃষ্টি রাখিতে হইবে। তিনি সত্য কথাই বাদশাহকে লিখিলেন, “আমি দিনরাতের মধ্যে এক মুহুর্ত্তের জন্যও বিশ্রাম ভোগ করি না, অথবা যে-কাজ হাতে লইয়াছি তাহার জন্য না ভাবিয়া থাকি না।”
মারাঠা-যুদ্ধের জন্য জয়সিংহের বন্দোবস্ত ও ফন্দী
কিন্তু বাধা-বিপত্তিই প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরীক্ষা করে। জয়সিংহ অতিশয় চাতুরী ও দক্ষতার সহিত ভাবী যুদ্ধের সব বন্দোবস্ত করিলেন। প্রথমতঃ তিনি নিজ পক্ষে যথাসম্ভব লোক আনিতে এবং শিবাজীর শত্রুদিগকে উত্তেজিত করিতে লাগিলেন। পুণায় পৌঁছিবার আগেই জানুয়ারি মাসে তিনি মুঘল-রাজ্যের বাসিন্দা দুইজন পোর্তুগীজ কাপ্তেন ফ্রান্সিস্কো এবং ডিওগো ডি মেলো’কে গোয়ার পোর্তুগাল-রাজপ্রতিনিধির নিকট পাঠাইয়া শিবাজীর নৌবল আক্রমণ করিবার জন্য সাহায্য চাহিলেন। জঞ্জিয়ার হাব্শী সর্দ্দার সিদ্দিকেও সেই মর্ম্মে পত্র লেখা হইল। বিদনুর, বাসবপটন, মহীশূর প্রভৃতি প্রদেশে হিন্দু রাজাদে নিকট জয়সিংহের ব্রাহ্মণ-দূতগণ গিয়া অনুরোধ করিল যে, এই সুযোগে তাঁহারা পুরাতন শত্রু বিজাপুর-রাজ্যের দক্ষিণ সীমানা আক্রমণ করুন। কোঁকনের উত্তরে কোলী-দেশের ছোট ছোট সামন্তদিগকে মুঘলপক্ষে আনিবার জন্য জয়সিংহের তোপখানার ফিরিঙ্গী সেনানী নিকোলো মানুশীকে পাঠান হইল।
দ্বিতীয়তঃ, যাহাদের সঙ্গে শিবাজীর কোন সময়ে শত্রুতা ছিল, সিংহ তাহাদের ডাকিয়া নিজ সৈন্যদলে স্থান দিলেন। মৃত আফজল খাঁর পুত্র এবং চন্দ্র রাও মোরের পুত্র বাজী চন্দ্ররাও পিতৃহত্যার প্রতিহিংসা লইবার এই সুযোগ ছাড়িল না। সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকা এবং মুঘল-রাজ্যে উচ্চ পদলোভের লোভ দেখাইয়া শিবাজীর কোন কোন কর্ম্মচারীকে ভাঙ্গাইয়া আনা হইল।
তাহার পর বিজাপুররাজকে লোভ ও ভয় দেখান হইল; যদি তিনি সত্যসত্যই মুঘলদের সাহায্য করেন তবে বাদশাহ আর তাঁহাকে শিবাজীর গোপন সহায়ক বলিয়া সন্দেহ করিবেন না এবং বার্ষিক করের টাকাও কিন্তু মাফ করিতে পারেন, এই আশ্বাস দেওয়া হইল। কিন্তু জয়সিংহের কৃতিত্বের সর্ব্বোচ্চ দৃষ্টান্ত এই যে, তিনি নিজে যে প্রণালীতে যুদ্ধ চালাইবেন স্থির করিয়াছিলেন তাহাতে বাদশাহর প্রথম আপত্তি কাটাইয়া দিয়া অনুমোদন লাভ করিতে সক্ষম হইলেন। কথাটা বুঝাইয়া দিতেছি। তাঁহার পুণায় পৌছিতে মার্চ্চ মাস আসিল, আর জুলাই হইতে বৃষ্টি আরম্ভ হইলে যুদ্ধ চালান অসম্ভব হইবে; সুতরাং শিবাজীকে পরাস্ত করিতে হইলে ইহার মধ্যবর্ত্তী তিন মাসেই সে কাজটি সম্পূর্ণ করা দরকার, নচেৎ আবার আটমাস বসিয়া থাকিতে হইবে। এজন্য জয়সিংহ স্থির করিলেন, সমস্ত বল সংগ্রহ করিয়া সবেগে মারাঠারাজ্যের কেন্দ্রে প্রচণ্ড আঘাত করিবেন, অন্যত্র যাইবেন না, বা সৈন্য চারিদিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া শক্তি হানি করিবেন না। বাদশাহ তাঁহাকে ধনশালী উর্ব্বর কোঁকন প্রদেশ আক্রমণ করিতে বারবার বলেন, কিন্তু জয়সিংহ দৃঢ়তার সহিত তাহা অস্বীকার করেন এবং এই যুক্তি দেন যে, মহারাষ্ট্রের হৃৎপিণ্ড পুণা অঞ্চল নিষ্কন্টক করিয়া হাত করিতে পারিলেই কোঁকন প্রভৃতি দূরের অঙ্গগুলি আপনা হইতে বশে আসিবে।
সর্ব্বশেষে জয়সিংহ বলিলেন যে, যুদ্ধে দুই-তিনজন প্রধানের হাতে মমতা ভাগ করিয়া দিলে, একমাত্র সর্বোচ্চ সেনাপতির কর্ত্ত্রৃত্বে সকলকে না রাখিলে, জয়লাভ অসম্ভব। বাদশাহ এই সৎ যুক্তি মানিয়া লইলেন এবং আজ্ঞা দিলেন যে, সৈন্য-বিভাগের সমস্ত নিয়োগ, কর্ম্মচ্যুতি, উন্নতি অবনতি, রসদ ও তোপ, সন্ধি করা ও ঘুষ দেওয়া,—সকল কাজেই একমাত্র জয়সিংহের হুকুম চলিবে, আওরঙ্গাবাদের সুবাদার কুমার মুয়জ্জমের নিকট কোন বিষয়ে মঞ্জুরী লওয়া বা আপিল করার প্রয়োজন হইবে না।
পুবন্দর-দুর্গ অবরোধ
দিল্লী হইতে বিদায় লইয়া, সৈন্যসহ দ্রুত কুচ করিয়া, পথের কোথাও অনাবশ্যক একদিনের জন্যও বিশ্রাম না করিয়া জয়সিংহ ৩রা মার্চ্চ পুণায় পৌছিলেন। প্রথমেই পুরন্দর আক্রমণ করা সাব্যস্ত করিলেন।
পুণা শহরের চব্বিশ মাইল দক্ষিণে পুরন্দর-দুর্গ। ইহাকে দুর্গ না বলিয়া সুরক্ষিত মহান্ গিরিসমষ্টি বলিলেই ঠিক হয়। নিজ পুরন্দরের চুড়া সমভূমি হইতে দুই হাজার পাঁচশত ফীট উঁচু; ইহাই বালা-কেল্লা বা উপরের দুর্গ, চারিপাশ খাড়া পাথর কাটা। আর ইহার তিনশত ফীট নীচে পাহাড়ের গা বাহিয়া নীচের দুর্গ (মারাঠ ভাষায় মাচী বলা হয়)। এই মাচীতে সৈন্যদের থাকিবার ঘর ও কার্য্যালয়, কারণ এটি বেশ প্রশস্ত। পূর্ব্বদিকে মাচীর কোণ হইতে এক মাইল লম্বা একটি সরু পাহাড়, তাহার শেষভাগ দেওয়ালে ঘেরা রুদ্রমালা বা বজ্রগড় নামে অপর একটি দুর্গ। এই বজ্রগড় হইতে মাচীর উপর গোলা বর্ষণ করিয়া সহজেই সেখান হইতে শত্রুদের তাড়াইয়া দেওয়া যায়।