শিবাজীকে খুন করিবার ষড়যন্ত্র
ভীরু ইনাএৎ খাঁ দুর্গের মধ্যে লুকাইয়া থাকিয়া শিবাজীকে খুন করিবার এক ফন্দী আঁটিল। বৃহস্পতিবারে সন্ধির প্রস্তাবের ভাণ করিয়া সে একজন বলিষ্ঠ যুবক কর্ম্মচারীকে শিবাজীর নিকট পাঠাইল। সে যাহা দিতে চাহিল তাহা এত অসম্ভবরূপে কম যে, শিবাজী ঘৃণার সঙ্গে বলিলেন, “তোমার প্রভু স্ত্রীলোকের মত ঘরের মধ্যে লুকাইয়া রহিয়াছে। সে কি মনে করে আমিও স্ত্রীলোক যে তাহার এই হাস্যকর প্রস্তাবে সন্মত হইব?” যুবকটি উত্তর দিল, “আমরা স্ত্রীলোক নহি। আপনাকে আরও কিছু বলিবার আছে।” এই বলিয়াই সে কাপড়ের মধ্য হইতে লুকান ছোরা বাহির করিয়া সবেগে শিবাজীর দিকে ছুটিয়া গেল। একজন মারাঠা শরীর-রক্ষক তরবারির এক কোপে তাহার হাত কাটিয়া ফেলিল বটে, কিন্তু যুবক বেগ থামাইতে পারিল না, হাতের সেই রক্তাক্ত কাটা কব্জা দিয়া শিবাজীকে আঘাত করিয়া দুজনে মাটিতে জড়াইয়া পড়িয়া গেল। শিবাজীর দেহে রক্তের দাগ দেখিয়া মারাঠারা চেঁচাইল—“সব বন্দীদের প্রাণ বধ কর” কিন্তু শীঘ্রই খুনী যুবককে হত্যা করা হইল, শিবাজী উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং বন্দীদের নিয়ে সামনে আনিতে বলিলেন। তাহার পর তাহাদের মধ্যে চারিনকে বধ করিয়া এবং চব্বিশজনের হাত কাটিয়া ফেলিয়া ক্ষান্ত হইলেন।
ইংরাজদের প্রশংসা ও পুরস্কার
রবিবার ১০ই জানুয়ারি রাতে দশটার পর মারাঠারা হঠাৎ সুরত হইতে চলিয়া গেল, এবং সন্ধ্যার মধ্যেই বারো মাইল দূরে পৌঁছিল, কারণ শিবাজী খবর পাইয়াছিলেন যে, একদল মুঘল-সৈন্য সুরতে আসিতেছে। এই দল ১৭ই তারিখে পৌঁছিলে, তবে ইনাএৎ খাঁ দুর্গের বাহিরে আসিতে সাহস পাইল। নগরবাসিগণ তাহাকে দেখিয়া ছি ছি করিতে লাগিল, কেহ বা কাদামাটি ছুঁড়িতে লাগিল। ইহাতে ইনাএতের পুত্র রাগিয়া একজন নির্দ্দোষ হিন্দু বানিয়াকে হত্যা করিল।
মুঘল-সৈন্যদল পৌঁছিবার পর ইংরাজবণিকগণ তাহার নেতাদের সঙ্গে দেখা করিলেন। শহরবাসীদের মুখে আর ইংরাজদের প্রশংসা ধরে না, তাহারা চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল, “এই সাহেবেরা নিজের কুঠীর আশপাশে আমাদের অনেকের বাড়ী রক্ষা করিয়াছেন। বাদশাহ ইহাদের পুরস্কার দিন।” নবাগত সেনাপতিও ইংরাজদের খুব ধন্যবাদ দিলেন। অক্সিণ্ডেন সাহেবের হাতে একটা পিস্তল ছিল, তিনি অমনি তাহা সেনাপতির সামনে রাখিয়া বলিলেন, “আমরা এখন অস্ত্র হাড়িয়া দিতেছি, কারণ ভবিষ্যতে আপনিই শহর রক্ষা করিবেন।” সেনাপতি শুনিয়া খুশী হইয়া বলিলেন, “আচ্ছা, আমি ইহা লইলাম, কিন্তু আপনাকে এক খেলাৎ, অশ্ব ও তরবারি উপহার দিব।” চতুর বণিকরা উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে, না। ওসব জিনিস সৈন্যদের সাজে; আমরা বণিক মাত্র, বাণিজ্যের সুবিধা ভিন্ন আর কোন পুরস্কার আমরা চাহি না।” .
বাদশাহ সুরতের দুর্দ্দশায় ব্যথিত হইয়া এক বৎসরের জন্য সকলেরই মাশুল মাফ করিলেন, এবং তাহার উপর ইংরাজ ও ডচ্দের পুরস্কার স্বরূপ তাহাদের আমদানী দ্রব্যের মাশুল শতকরা এক টাকা কমাইয়া দিলেন। [এই অনুগ্রহ নবেম্বর ১৬৭৯ অবধি চলিয়াছিল।]
০৫. জয়সিংহ ও শিবাজী
পঞ্চম অধ্যায় – জয়সিংহ ও শিবাজী
১৬৬৪ সালে যুদ্ধ ইত্যাদি
সুরত-লুঠের পর এক বৎসর পর্য্যন্ত মুঘল পক্ষে আর কিছুই কাজ হইল না। সুবাদার কুমার মুয়জ্জম্ (শাহ আলম্) আওরঙ্গাবাদে থাকিয়া আমোদ-প্রমোদে দিন কাটাইতে লাগিলেন। মহারাজা যশোবন্ত সিংহ রাঠোর, সিংহগড় দুর্গ অবরোধ করিয়া শেষে নিষ্ফল হইয়া ফিরিলেন (২৮ মে ১৬৬৪)। শিবাজীর দল নানা স্থানে লুঠতরাজ করিতে লাগিল; আজ মহারাষ্ট্র, কাল কানাড়ায়, পরশু পশ্চিম তীরদেশে। লোকে ভয়ে বিস্ময়ে বলিতে লাগিল, “শিবাজী মানুষ নহেন, তাঁহার বায়বীয় শরীর আছে, ডানা আছে। নচেৎ, তিনি কিরূপে একই সময়ে এত দূর দূর বিভিন্ন স্থানে যাইতে পারিতেছেন?” “তিনি সর্ব্বদাই অসীম ক্লেশ সহ্য করিয়া দ্রুত কুচ করিতেছেন, এবং তাঁহার কর্ম্মচারীদেরও সেইমত চালাইয়া লইয়া যাইতেছেন। সমস্ত দেশময় রাজারা তাঁহার ত্রাসে কম্পমান। দিন দিন তাঁহার শক্তি বাড়িতেছে।” [ইংরাজ-কুঠীর চিঠি]
এই সময়, ২৩এ জানুয়ারি ১৬৬৪, ঘোড়া হইতে পড়িয়া শাহজীর মৃত্যু হইল। তাঁহার যত অস্থাবর সম্পত্তি এবং মহীশূর ও পূর্ব্ব-কর্ণাটকের জাগীর শিবাজীর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ব্যঙ্কাজী (অথবা একোজী) অধিকার করিলেন।
উপর্য্যুপরি এইসব ক্ষতি ও লজ্জাকর পরাজয় ভোগ করিয়া, আওরংজীব অনেক ভাবিয়া শিবাজীকে দমন করিবার জন্য মীর্জা রাজা জয়সিংহ কাছোয়া (আম্বের, অর্থাৎ বর্ত্তমান জয়পুর-রাজ্যের অধিপতি)-কে নিযুক্ত করিলেন (৩০ সেপ্টেম্বর ১৬৬৪)। তাঁহার সঙ্গে বিখ্যাত পাঠানবীর দিলির খাঁ, আরব সেনানী দাউদ খাঁ, সুজন সিংহ বুন্দেলা ও অন্যান্য সেনাপতি এবং চৌদ্দ হাজার সৈন্য দেওয়া হইল।
জয়সিংহেব চরিত্র
জয়সিংহ মধ্যযুগের ভারত-ইতিহাসের একটি অদ্বিতীয় পুরুষ। রাজপুত বলিলে আমরা সচরাচর বুঝি, কোন অসীমসাহসী, মান্যপ্রিয়, ধন ও স্বার্থে নিস্পৃহ, গোঁয়ারগোবিদ বীর ও ত্যাগী। জয়সিংহ যুদ্ধপটু ভয়হীন তেজী পুরুষ হইলেও সেই সঙ্গে কুটনীতিতে, সভ্যতা-ভব্যতায়, লোকজনকে হাত করিয়া কাজ হাসিল করিবার ক্ষমতাতেও কম পরিপক্ক ছিলেন না। ফলতঃ সম্ভ্রান্ত রাজপুত ও মুঘল—এই দুই শ্রেণীরই সব গুণগুলি তাঁহার মধ্যে একাধারে ছিল। বারো বৎসর বয়সে এই পিতৃহীন বালক মুঘলসেনাবিভাগে প্রবেশ করেন (১৬১৭); তাহার পর জাহাঙ্গীরের শেষকাল এবং শাহজাহানের সমগ্র রাজত্বের ইতিহাস তাঁহার কীর্ত্তিতে উজ্জ্বল। সুদুর আফঘানিস্থানের কান্দাহার হইতে পূর্ব্ব প্রান্তে মুঙ্গের পর্যন্ত, আর উত্তরে অক্শশ্, নদীর তীর হইতে দাক্ষিণাত্যে বিজাপুর পর্যন্ত, সর্ব্বত্রই মুঘল-সৈন্য লইয়া তিনি লড়িয়াছেন এবং সর্ব্বত্রই যশ লাভ করিয়াছেন। রাজনীতির চাল চালিতেও কম দক্ষ ছিলেন না। বাদশাহ সব বিপদে, সব কঠিন কাজে জয়সিংহের উপর নির্ভর করিতেন।