শিবাজীর প্রথম সুরত লুণ্ঠন
বাছা বাছা দ্রুতগামী অশ্বে চারি হাজার সৈন্য চড়াইয়া শিবাজী বম্বের কাছ হইতে গোপনে বেশে অগ্রসর হইয়া সুরতের নিকট পৌছিলেন, পথে দুইজন কোলী রাজা লুঠের ভাগ পাইবার লোভে ছয় হাজার সৈন্য লইয়া তাঁহার সঙ্গে যোগ দিলেন। বুধবার (৬ই জানুয়ারি ১৬৬৪) দুপুর বেলা শিবাজী সুরত শহরের বাহিরে আসিয়া পৌঁছিলেন, এবং “বুর্হানপুর দরজার” সিকি মাইল দূরে একটি বাগানে নিজ তাম্বু খাটাইলেন। মারাঠা অশ্বরোহিগণ অমনি অরক্ষিত অর্ধজনশূন্য শহরে ঢুকিয়া বাড়ীঘর লুঠ করিয়া তাহাতে আগুন ধরাইয়া দিতে লাগিল। একদল শহরের মধ্য হইতে দুর্গের দেওয়াল লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ছুঁড়িতে লাগিল, ভয়ে দুর্গরক্ষী বীরগণ কেহই মাথা তুলিল না, বা শহর-লুঠে বাধা দিল না।
বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি এই চারিদিন ধরিয়া শহর অবাধে লুন্ঠিত হইল। মারাঠারা প্রত্যহ নূতন নূতন পাড়ায় ঘর জ্বালাইয়া দিতে লাগিল। সে সময় সুরতে পাকা বাড়ী দশ-বিশটার অধিক ছিল না, বাকী হাজার হাজার বাড়ীতে কাঠের খুঁটি, বাঁশের দেওয়াল, খড় বা খোলার চাল, এবং মাটির মেঝে। এ হেন স্থানে মারাঠাদের অগ্নিকাণ্ড সহজেই “রাত্রিকে দিনের মত উজ্জ্বল এবং ধুমবৃষ্টি দিনকে রাত্রির মত অন্ধকার করিয়া তুলিল—সূর্যের মুখ ঢাকিয়া দিল।” [ইংরাজ পুরোহিতের বিবরণ]
ডচ্ কুঠীর কাছে সুরতের—সুরতের কেন, সমস্ত এশিয়াখণ্ডের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ধনী বহরঙ্গী বোরার প্রাসাদ অরক্ষিত জনশূন্য দেখিয়া, মারাঠার তিনদিন তিনরাত্রি ধরিয়া তাহার মেঝে খুঁড়িয়া লুঠ করিল, সমস্ত ধনরত্ন এবং আটাশ সের মোতির বোঝা লইয়া অবশেষে ঘরে আগুন দিয়া প্রস্থান করিল। ইংরাজ-কুঠীর নিকটে আরও একজন মহাধনী হাজী সাইদ বেগের বাড়ীতে ঢুকিয়া, তাহারা সারা দিনরাত্রি দরজা-বাক্স ইত্যাদি ভাঙ্গিয়া যত পারিল টাকা সরাইল। গুদামে ঢুকিয়া পারদের পিপা ভাঙ্গিয়া তাহা মাটিতে ছড়াইয়া দিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার বৈকালে যখন পঁচিশজন মারাঠা-সৈন্য ইংরাজ কুঠীর নিকটস্থ একটি ঘরে আগুন লাগাইতে উদ্যত, সেই সময় ইংরাজেরা কুঠী হইতে বাহির হইয়া মারিয়া তাড়াইয়া দেওয়ায়, সাইদ বেগের বাড়ীর মারাঠা দলও ভয়ে সরিয়া পড়িল। পরদিন ইংরাজেরা কয়েকজন নিজের লোক পাঠাইয়া ঐ বণিকের বাড়ী রক্ষার ভার লইল। এইরূপ ধনের খনি হাত-ছাড়া হওয়াতে শিবাজী চটিয়া ইংরাজ-কুঠিতে বলিয়া পাঠাইলেন, “হয় আমাকে তিন লক্ষ টাকা দাও, না হয় হাজী সাইদের বাড়ী লুঠিতে দাও। নতুবা আমি স্বয়ং আসিয়া, তোমাদের সকলের গলা কাটিব এবং কুঠী ভূমিসাৎ করিয়া দিব।” সুচতুর ইংরাজ-নেতা উত্তর দিবার জন্য কিছু সময় চাহিয়া লইয়া শনিবার প্রাতঃকাল (অর্থাৎ চতুর্থ দিন) পর্য্যন্ত কাটাইলেন, তাহার পর শিবাজীকে খবর পাঠাইলেন—“আমরা দুইটি শর্ত্তের কোনটিতেই রাজি নহি; আপনি যাহা করিতে পারেন করুন; আমরা প্রস্তুত আছি, পলাইব না। যে সময় ইচ্ছা এই কুঠী আক্রমণ করুন। আর, এই কুঠী লইবার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, বলিতেছেন; বেশ ত, যখন আসিবার ইচ্ছা করিয়াছেন তাহার এক প্রহর আগেই আসিবেন।” শিবাজী আর কিছুই করিলেন না; তিনি সুরত হইতে অবাধে এক কোটির অধিক টাকা পাইয়াছেন, তবে আর কেন দুই-এক লাখের জন্য স্থির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইংরাজদের তোপের মুখে নিজ সৈন্য নষ্ট করিবেন?
মারাঠাদের সুরতে অত্যাচার ও খুন
সুরত-লুণ্ঠনের ফলে অগণিত ধন লাভ হইল। বহু বৎসরেও এই সময়ের মত অর্থ রত্ন ইত্যাদি শহরে সংগৃহীত হয় নাই। মারাঠারা সোনা, রূপা, মোতি হীরা ও রত্ন ভিন্ন আর কিছুই ছুঁইল না।
মারাঠারা সুরতবাসীদের ধরিয়া আনিয়া কোথায় তাহারা নিজ নিজ ধন-সম্পত্তি লুকাইয়া রাখিয়াছে তাহার সন্ধানের জন্য কোন প্রকার নিষ্ঠুর পীড়নই বাকী রাখিল না; চাবুক মারা হইল, প্রাণ বধের ভয় দেখান হইল, কাহারও এক হাত কাহারও বা দুই হাত কাটিয়া ফেলা হইল, এবং কতক লোকের প্রাণ পর্য্যন্ত লওয়া হইল। “মিষ্টার এন্টনি স্মিথ (ইংরাজ-বণিক) স্বচক্ষে দেখিলেন যে, শিবাজীর শিবিরে একদিনে ছাব্বিশজনের মাথা এবং ত্রিশজনের হাত কাটিয়া ফেলা হইল; বন্দীদের যে-কেহ যথেষ্ট টাকা দিতে পারিল না তাহার অঙ্গহানি বা প্রাণবধের আজ্ঞা হইল। শিবাজীর লুঠের প্রণালী এইরূপ, প্রত্যেক বাড়ী হইতে যাহা সম্ভব লইয়া, গৃহস্বামীকে বলা হইল যে যদি বাড়ী বাঁচাইতে চাও ত তাহার জন্য আরও কিছু দাও। কিন্তু যে-মুহূর্ত্তে সেই টাকা আদায় হইল, অমনি নিজ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া ঘরগুলি পুড়াইয়া দিলেন।” [সুরত কুঠীয় পত্র] একজন বুড়া বণিক আগ্রা হইতে চল্লিশটি বলদ বোঝাই করিয়া কাপড় আনিয়াছিল, কিন্তু তাহা বিক্রয় না হওয়ায়, নগদ টাকা দিতে না পারিয়া সে ঐ সমস্ত মাল শিবাজীকে দিতে চাহিল; তবুও তাহার ডান হাত কাটিয়া তাহার কাপড়গুলি পুড়াইয়া তাহাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইল। অথচ একজন ইহুদী মণি-বিক্রেতা বেশ বাঁচিয়া গেল; সে আমার কিছু নাই বলিয়া কাঁদিতে লাগিল; মারাঠারাও ছাড়িবে না, তাহাকে বধ করিবার হুকুম হইল; তিন তিনবার তরবারি তাহার মাথার চারিদিকে ঘুরাইয়া ঘাড়ে ছোঁয়ান হইল, কিন্তু সে কিছুই দিতে না পারিয়া যেন মৃত্যুর অপেক্ষায় বসিয়া আছে এরূপ ভাণ করিল; অবশেষে আশা নাই দেখিয়া শিবাজী তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। ইংরাজকুঠীর কর্ম্মচারী এন্টনি স্মিথ ডচ্ ঘাটে নামমাত্র বন্দী হইয়া তিন দিন শিবাজীর শিবিরে আবদ্ধ ছিলেন; অন্যান্য বন্দীর সহিত তাঁহার ডান হাত কাটার হুকুম হইল; কিন্তু তিনি উর্দ্দু ভাষায় চেঁচাইয়া শিবাজীকে বলিলেন, “কাটিতে হয় আমার মাথা কাট, হাত কাটিও না।” তখন মারাঠারা তাঁহার মাথায় টুপী খুলিয়া দেখিল যে, তিনি ইংরাজ; দণ্ডাজ্ঞা রদ হইল। পরে তিনশত পঞ্চাশ টাকা দিয়া তিনি মুক্ত হন। স্মিথ চোখে দেখিয়া শিবাজী-সম্বন্ধে একটি সুন্দর বর্ণনা লিখিয়া গিয়াছেন।