সুরত বন্দরের বর্ণনা
ভারতের পশ্চিমে সাগর-কুল হইতে বাৱে মাইল দূরে তাপ্তী নদীর তীরে সুরত নগর। অনেক আগে এখানে বড় বড় জাহাজের যাতায়াত হিল, কিন্তু এখন নদীর মুখ এই শহর হইতে ছয় সাত ক্রোস পশ্চিমে সরিয়া গিয়াছে, কাজেই সমুদ্রগামী জাহাজগুলি সেই মুখের কাছে, সুহায়িলী (ইংরাজী Swally Hole) নামক স্থানে নোঙ্গর করিয়া থাকে, আর অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজ ও নৌকা নদী উজাইয়া সুরতে আসে। তবুও, সুরত মুঘল-ভারতে সর্ব্বপ্রধান বন্দর ছিল। বাণিজ্যের মাশুলের আয়ে এবং ধনরত্নে এক দিল্লী ভিন্ন আর কোন নগর ইহার সমকক্ষ ছিল না। প্রাচীন হিন্দুযুগে ইহার কিছু উত্তরে নর্ম্মদার মুখের কাছে ভারুকচ্ছ (বর্ত্তমান ভরোচ, প্রাচীন গ্রীক নাম বার্গজা) শ্রেষ্ঠ বন্দর বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিল বটে, কিন্তু সেদিন চলিয়া গিয়াছে। ইহা ভিন্ন সুরত হইতে মক্কা-মদিনার যাত্রী লইয়া জাহাজ হাড়িত; এজন্য ইহার নাম ছিল “ইসলামের পুণ্য তীর্থের দ্বার”। এখান হইতেই ভারতীয় মুসলমানগণ আরব দেশের জন্য তীর্থযাত্রা করিতেন।
সুরতের দুই অংশ, একটি দুর্গ ও অপরটি শহর। দুর্গটি ছোট ও সুরক্ষিত। কিন্তু শহরটি চারি বর্গমাইল বিস্তৃত, ধনেজনে পরিপূর্ণ। লোকসংখ্যা দুই লক্ষ; বাণিজ্য-দ্রব্যের মাশুল হইতে রাজকোষে বৎসরে বারো সক্ষ টাকা আয় হইত, অর্থাৎ আমদানী জিনিসের মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ছিল। এ সময়ে শহরের চারিদিকে প্রাচীর ছিল না, শুধু স্থানে স্থানে বাহির হইতে আসিবার রাস্তার মুখে সামান্য রকমের ফটক এবং কোথাও কোথাও শুস্ক পরিখা ছিল, তা সহজেই পার হওয়া যাইত।
সুরত শহরের ধনরত্নের তুলনা ভারতের অন্যত্র পাওয়া কঠিন। এই নগরে এক বহরজী বোরার সম্পত্তির পরিমাণই আশী লক্ষ টাকা, তাহার পর হাজী সাইদ্ বেগ ও অন্য বণিকদের ত কথাই নাই। অথচ শহর রক্ষার বন্দোবস্ত মোটই ছিল না। শহরের শাসনকর্ত্তা পাঁচশত রক্ষী সৈন্যের বেতন রাজদরবার হইতে পাইতেন বটে, কিন্তু লোকজন রাখিতেন না,টাকাটা নিজের সুখের জন্য ব্যয় করিতেন। নগরবাসিগণও শান্তিপ্রিয়, দুর্ব্বল এবং ভীরু, অধিকাংশই অহিংস জৈন, শুচিবাইগ্রস্ত অগ্নি-উপাসক পারসী, অথবা অর্থপ্রিয় দোকানী এবং নিরীহ গুজরাতী কারিগর। ইহারা আত্মরক্ষার জন্য কি যুদ্ধ করিবে? মহাধনী ভারতীয় বণিকগণও নিজ সম্পত্তির সহস্রাংশ ব্যয় করিয়া চৌকিদার এবং সিপাহী রাখার আবশ্যকতা অনুভব করেন নাই। ____ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহর পক্ষে ইনাএৎ খাঁ সুরত বন্দরের শাসনকর্ত্তা ছিল; লোকটি যেমন অর্থলোভী তেমনই কাপুরুষ ও অকর্ম্মণ্য। কিন্তু দুর্গটি একজন সৈনিক কর্মচারীর হাতে ছিল, সে ইনাএৎ-এর অধীনতা স্বীকার করিত না।
ইংরাজ কুঠীর আশ্চর্য্য আত্মরক্ষা
মঙ্গলবার, ৫ই জানুয়ারি, প্রাতে সুরতবাসিগণ সভয়ে শুনিল দুইদিন পূর্ব্বে শিবাজী সসৈন্য আটাশ মাইল দক্ষিণে পৌঁছিয়াছেন, এবং সুরতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হইতেছেন। অমনি শহরময় শোরগোল উঠিল আতঙ্কে লোকজন পলাইতে সুরু করিল। যে পারিল স্ত্রীপুত্র লইয়া নদী পার হইয়া দূরবর্ত্তী গ্রামগুলিতে আশ্রয় লইল। ধনী লোকেরা দুর্গের অধ্যক্ষকে ঘুষ দিয়া সপরিবারে তথায় স্থান পাইলেন; তাহাদের মধ্যে শহরের রক্ষক ইনাএৎ খাঁ সর্ব্বপ্রথম।
অথচ মুষ্টিমেয় ইউরোপীয় দোকানদার এই সময়ে আশ্চর্য্য সাহস দেখাইয়া নিজ ধন প্রাণ মান বাঁচাইতে সক্ষম হইল। সুরতের ইংরাজ ও ডচ্ বণিকগণ নিজ নিজ কুঠীতে অস্ত্র লইয়া দাঁড়াইয়া শিবাজীর সমস্ত সৈন্যবলকে হটাইয়া দিল। তাহাদের কুঠীগুলি সাধারণ খোলাবাড়ী,— দুর্গ নহে, চারিদিকে সীমানা-ঘেরা দেওয়াল পর্য্যন্ত ছিল না। ইংরাজ-কুঠীর প্রধান, স্যার জর্জ অকসিণ্ডেন, ইচ্ছা করিলে সহজেই সুহায়িলীতে পলাইয়া প্রাণ বাঁচাইতে পারিতেন, কিন্তু তাহা না করিয়া স্বয়ং সুরতে থাকিয়া যুদ্ধের নেতৃত্ব লইলেন। সত্বর ছয়টি ছোট ছোট কামান সংগ্রহ করিয়া, সুহায়িলী হইতে জাহাজী গোরা আনিয়া, মোট একশত পঞ্চাশ জন ইংরাজ এবং ষাটজন পিয়নকে সুরতের কুঠী রক্ষা করিবার জন্য সজ্জিত করা হইল। চারিটি কামান ছাদের উপর বসান হইল, তাহার গোলা পাশের দুটি রাস্তা এবং নিকটবর্ত্তী হাজী সাইদ বেগের বাড়ীর উপর পড়িতে পারিত। আর দুইটি তোপ সদর-দরজার পিছনে বসান হইল, এবং ঐ দরজায় এমন করিয়া দুটি ছিদ্র করা হইল যাহাতে তাহার মধ্য দিয়া কামানের মুখ বাহির হইতে পারে এবং রাস্তা হইতে কুঠীতে আসিবার পথে যে ঢুকিবে তাহাকে উড়াইয়া দেওয়া যায়। তাড়াতাড়ি কয়েক দিনের জন্য খাদ্য ও জল আনিয়া মজুত করা হইল। ইংরাজদের কেহ সীসা দিয়া গুলি প্রস্তুত করিতে সুরু করিল, কেহ অপর যুদ্ধ-সামগ্রী তৈয়ারে মন দিল, কেহ বা কুঠীর দেওয়াল মেরামত করিয়া দৃঢ়তর করিল। প্রত্যেক লোককে নিজের নির্দ্দিষ্ট স্থান চিনাইয়া দেওয়া হইল, তাহাদের তত্ত্বাবধানের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক নেতা (কাপ্তেন) নিযুক্ত হইল। কাজের জন্য শৃঙ্খলা, সুন্দর ব্যবস্থা, এবং আগে হইতেই ভাবিয়া উপায় ঠিক করিয়া রাখা হইল। বুধবার প্রাতে অক্সিণ্ডেন তাঁহার দুইশত অনুচর লইয়া ঢাক তুরী বাজাইয়া শহরের মধ্য দিয়া কুচ করিয়া আসিলেন এবং প্রকাশ্যভাবে বলিতে লাগিলেন, “এই কয়টি লোক লইয়াই আমি শিবাজীর গতি রোধ করিব। ডচেরাও তাহাদের কুঠী রক্ষার জন্য সজিত হইল; এবং এই-সব আয়োজন দেখিয়া কতকগুলি তুর্কী ও আরমানী-বণিক নিজ নিজ সম্পত্তি একটি সরাই-এ লইয়া গিয়া তাহাকে দুর্গে পরিণত করিল। আর “ভারত? শুধু ঘুমাইয়া” রহিল।