তখন রমজান মাস। এই মাসে মুসলমানেরা দিবাভাগ উপবাসে কাটাইয়া রাত্রে আহার করে। সারা দিন উপবাসের পর প্রথম রাতে গুরু ভোজন করিয়া নবাবের বাড়ীর সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। শুধু জনকয়েক পাচক জাগিয়া—সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে খাইবার খানা রাঁধিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহারা কোন শব্দ করিবার পূর্ব্বেই মারাঠারা গিয়া তাহাদের কাটিয়া ফেলিল। এই রান্নাঘরটি বাহিরে, ইহার গায়েই অন্দরমহলের চাকরদিগের থাকিবার ঘর, মধ্যে একটি দেওয়াল খাড়া। পূর্ব্বে এই দেওয়ালে একটি ছোট দরজা ছিল, শায়েস্তা খাঁ সেই দরজার ফাঁক ইট দিয়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন। শিবাজীর সঙ্গীরা শাবল দিয়া দরজার ইটগুলি খুলিতে লাগিল। সেই শব্দে ওপাশের, অর্থাৎ অন্দরমহলের, চাকরেরা জাগিয়া উঠিল এবং খাঁকে জানাইল যে বোধ হয় চোরে সিঁধ কাটিতেছে। এই সামান্য কারণে নিদ্রার ব্যাঘাত করায় খাঁ চটিয়া, ধমক দিয়া তাহাদের তাড়াইয়া দিলেন।
ইট সরাইয়া ক্রমে দেওয়ালের ছিদ্র মানুষ ঢুকিবার মত বড় করা হইল। প্রথমেই শিবাজী নিজে তাঁহার রক্ষী চিম্নাজী বাপুজীকে লইয়া অন্দরমহলে প্রবেশ করিলেন, পিছু পিছু চলিল তাঁহার দুই শত সৈন্য। বাকী দুইশত বীর বাবাজী বাপুজীর অধীনে ছিদ্রের বাহিরে খাড়া রহিল। তরবারি ও ছোরা দিয়া কানাৎ কাটিয়া পথ করিয়া সদলে শিবাজী তাঁবুর পর তাঁবু পার হইয়া শেষে শায়েস্তা খাঁর শয়নকক্ষে গিয়া হাজির। তাঁহাদের দেখিয়া অন্দরের স্ত্রীলোকেরা ভয়ে খাঁকে জাগাইল। কিন্তু খাঁ তরবারি ধরিবার আগেই শিবাজী তাঁহার উপর লাফাইয়া পড়িয়া এক কোপে তাঁহার হাতের আঙ্গুল কাটিয়া দিলেন। এই সময় অন্দরের এক চতুর দাসী বুদ্ধি করিয়া ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিল; মারাঠারা অন্ধকারেই তলোয়ার চালাইতে লাগিল। দু’জন মারাঠা অন্ধকারে পথ দেখিতে না পাইয়া জলের চৌবাচ্চায় পড়িয়া গেল। এই গোলমালের সুযোগে দাসীরা খাঁ-সাহেবকে নিরাপদ স্থানে সরাইয়া ফেলিল। কিন্তু অন্দরমহলে শিবাজীর লোকজন পুরাদমে সংহার-কার্য্য চালাইতে লাগিল, ছয়জন বাঁদী হত এবং আটজন আহত হইল।
এদিকে শিবাজীর অপর দুইশত সঙ্গী বাহিরের রক্ষীগৃহে ঢুকিয়া নিদ্রিত ও অর্ধনিদ্রিত প্রহরীদের হত্যা করিল, আর বিদ্রুপ করিয়া বলিতে লাগিল, “তোরা বুঝি এমনি করিয়া ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া পাহারা দিস্?” তাহার পর নহবতের ঘরে ঢুকিয়া বলিল, “খাঁ-সাহেবের হুকুম, খুব জোরে বাজাও।” তখন জয়ঢাক, তুরী ভেরী ও করতালের শব্দের সহিত মারাঠাদের চীৎকার মিশিয়া এক তাণ্ডব ব্যাপার সৃষ্টি করিল। অন্দর হইতে আর্ত্তনাদ এবং মারাঠাদের হুঙ্কার শুনিয়া মুঘল-সৈন্যগণ বুঝিতে পারিল তাহাদের সেনাপতিকে শত্রু আক্রমণ করিয়াছে। অমনি চারিদিকে সাজ সাজ রব উঠিল।
শায়েস্তা খাঁর পুত্র আবুল ফৎ সকলের আগে পিতাকে বাঁচাইবার জন্য ছুটিলেন। কিন্তু একাকী কি করিবেন? তিনিও শত্রুহস্তে নিহত হইলেন। একজন মুঘল-সেনানীর বাসা ছিল অন্দরমহলের পাশেই। মারাঠারা অন্দরের দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়াছে দেখিয়া, তিনি দড়ি বাহিয়া অন্দরের আঙ্গিনায় লাফাইয়া পড়িলেন; শত্রুরা অবিলম্বে তাঁহাকেও হত্যা করিল। এইরূপে শায়েস্তা খাঁর এক পুত্র, ছয়জন বাঁদী ও চল্লিশজন রক্ষী হত এবং নিজে, দুই পুত্র ও আটজন বাঁদী আহত হইল। মারাঠাদের পক্ষে শুধু ছয়জন লোক মারা যায় এবং চল্লিশজন জখম হয়।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এ-সব কাণ্ড ঘটিয়া গেল। এদিকে শিবাজী দেখিলেন, শত্রু এখন সজাগ—রণসজ্জা করিতেছে, তাঁহার আর বিলম্ব করা উচিত নয়। তিনি নিজ অনুচরদের একত্র করিয়া শিবির হইতে দ্রুত বাহির হইয়া পড়িলেন এবং যশোবন্তের তাঁবুগুলির পাশ দিয়া সোজা দক্ষিণে সিংহগড়ে চলিয়া গেলেন। মুঘলেরা তাঁহাকে ধরিবার জন্য সমস্ত শিবিরের মধ্যে অন্ধকারে এদিক-ওদিক বৃথা খুঁজিতে লাগিল। তাহারা স্বভাবতঃই ভাবিয়াছিল যে মারাঠারা সংখ্যায় অন্তত দশ-বিশ হাজার হইবে।
শায়েস্তা খাঁর দুঃখ ও শাস্তি
১৬৬৩ সালের ৫ই এপ্রিল তারিখে এই ঘটনা ঘটে। পরদিন প্রাতে সমস্ত মুঘল-কর্ম্মচারীরা সেনাপতির শোকে সমবেদনা জানাইবার জন্য তাঁহার দরবারে উপস্থিত হইলেন। ইঁহাদের মধ্যে যশোবন্ত সিংহ ছিলেন, তাঁহার অধীনে দশ হাজার সৈন্য এবং তাঁহার শিবির শিবাজীর পথে, অথচ তিনি শত্রুর আসা-যাওয়ার সময় কোন বাধাই দেন নাই এবং পশ্চাদ্ধাবনও করেন নাই। তাঁহার কপট দুঃখের কথাগুলি শুনিয়া শায়েস্তা খাঁ বলিলেন, “আঁ। আপনি বাঁচিয়া আছেন দেখিতেহি। কাল রাত্রে যখন শত্রু আমাকে আক্রমণ করে, আমি ভাবিয়াছিলাম আপনি তাহাদের বাধা দিতে গিয়া প্রাণ হারাইয়াছেন, তবেই ত তাহারা আমার কাছে পৌঁছিতে পারিয়াছে।”
ফলতঃ,দেশের সর্ব্বত্র লোকেরা বলাবলি করিতে লাগিল যে, শিবাজী যশোবন্তের সহিত যুক্তি করিয়া এই কাণ্ড করিয়াছেন। ইংরাজ-বণিকেরাও এই দুর্নামের কথা লিখিয়া গিয়াছে। কিন্তু শিবাজী নিজের অনুচরদিগকে বলিতেন, “আমি যশোবন্তেরর কথায় এ কাজ করি নাই, আমার পরমেশ্বর আমাকে ইহা করাইয়াছেন।”
মহারাষ্ট্রে থাকা মোটই নিরাপদ নহে দেখিয়া, লজ্জা ও শোকে অভিভূত শায়েস্তা খাঁ আওয়ঙ্গাবাদে উঠিয়া আসিলেন। তাঁহার অসাবধানতা ও অকর্ম্মণ্যতার ফলেই এই বিপদ ঘটিয়াছে ভাবিয়া বাদশাহ শাস্তিস্বরূপ মাতুল শায়েস্তা খাঁকে বাঙ্গলায় বদলি করিলেন, কারণ তখন বাঙ্গলার নাম ছিল “রুটিপূর্ণ নরক”। বাঙ্গলা যাইবার পথে বাদশাহের সহিত দেখা করিতে পর্য্যন্ত শায়েস্তা খাঁকে নিষেধ করা হইল। ১৬৬৪ সালের জানুয়ারীর প্রথমে কুমার মুয়জ্জম্ (শাহ আলম্) দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হইয়া রাজধানী আওরঙ্গাবাদে পৌঁছিলেন এবং শায়েস্তা খাঁ বাঙ্গলার দিকে রওনা হইলেন। এই বদলির সুযোগে শিবাজী অবাধে মনের সুখে সুরত বন্দর লুঠ করিলেন (৬-১০ই জানুয়ারী)।