শিবাজী দেখিলেন অবস্থা সাংঘাতিক, তিনি ফাঁদে পড়িয়াছেন, পলায়নের পথ রুদ্ধ। ১৩ই জুলাই, আষাঢ় কৃষ্ণ-প্রতিপদের রাত্রে পনহালায় কিছু সৈন্য রাখিয়া, অবশিষ্ট লোকজন-সমেত তিনি দুর্গ হইতে গোপনে নামিলেন, পবনগড়ের সম্মুখস্থ বিজাপুরী শিবির আক্রমণ করিলেন, এবং সেই গোলমালের সুযোগে বিশালগড় দুর্গের দিকে পলাইবার ব্যবস্থা করিলেন।
পনহালা হইতে শিবাজীর পলায়ন
কিন্তু বিশালগড় ২৭ মাইল দূরে, পথও অতি দুর্গম, উঁচুনীচু, পাথর-ছড়ান এবং সঙ্কীর্ণ। পরদিন প্রভাত-কিরণে দেখা গেল যে তথায় পৌঁছিতে আরও আট মাইল পথ বাকী আছে। এদিকে রাতেই শিবাজীর পলায়নের সংবাদ এবং তাঁহার পথের ঠিক সন্ধান পাইয়া ফজল খাঁ মাহতাব্ জ্বালাইয়া তাঁহার পিছু পিছু আসিয়াছেন। এখন দিনের আলোতে অসংখ্য শক্রসেনা মারাঠাদের পিষিরা মারিবে।
এই মহাবিপদে বাজীপ্রভু নামক কায়স্থ-জাতীয় মাব্লে জমিদার নিজ প্রাণ বিসর্জ্জন দিয়া শিবাজীকে রক্ষা করিলেন। গজপুরের নিকট পথটি অতি সঙ্কীর্ণ, দুদিকেই উঁচু পাহাড় উঠিয়াছে। বাজীপ্রভু বলিলেন, “মহারাজ। আমি অর্দ্ধেক সৈন্য লইয়া এই স্থানটিতে মুখ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া শত্রুসেনাকে দাবাইয়া রাখি। আপনি সেই সুযোেগে অবশিষ্ট রক্ষী লইয়া বিশালগঞ্জে দ্রুত প্রস্থান করুন। তথায় নিরাপদে পৌঁছিলে তোপের আওয়াজ করিয়া আমাকে সে সুসংবাদ দিবেন।”
গজপুরের গিরিসঙ্কট মারাঠা-ইতিহাসের থার্মোপলি। সকাল হইতে পাঁচ ঘণ্টা পর্য্যন্ত বারে বারে প্রবল বিজাপুরী সৈন্যদল বন্যার মত আসিয়া সেই সঙ্কীর্ণ পিরিপথে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতেছে, আর মুষ্টিমেয় মারাঠারা প্রাণপণে লড়িয়া তাঁহাদের হটাইয়া দিতেছে। সাত শত মারাঠা-সৈন্য সেখানে প্রাণ দিল, বাজীপ্রভুও আহত হইয়া রণক্ষেত্রে পড়িয়া গেলেন, তবু যুদ্ধের বিরাম নাই। দ্বিপ্রহর বেলায় পশ্চাতে আট মাইল দূর হইতে তোপধ্বনি শোনা গেল। শিবাজী বিশালগড়ে আশ্রয় পাইয়াছেন। বাজীপ্রভু প্রাণ দিয়া পণ রক্ষা করিলেন। বিজাপুর-পক্ষের কর্ণাটকী বন্দুকচীরা গুলির পর গুলি চালাইয়া ঐ গিরিসঙ্কট জয় করিল, অবশিষ্ট মাব্লেরা মৃত সেনানীর দেহ লইয়া পাহাড়ে পলাইয়া গেল।
সুলতান আলি আদিল শাহ জোহরের বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় পাইয়া “দুই বিদ্রোহীকেই” দমন করিবার জন্য স্বয়ং রাজধানী হইতে পনহালার দিকে অগ্রসর হইলেন। জৌহর দেখিলেন আর ত ফাঁকি দেওয়া চলে না; তখন তিনি ২২এ সেপ্টেম্বর মারাঠাদের হাত হইতে পনহালা দুর্গ ফিরাইয়া লইয়া সুলতানকে অর্পণ করিলেন।
শায়েস্তা খাঁর পুণা ও চাকন অধিকার
যখন শিবাজীর রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে তাঁহার এই পরাজয় ও ক্ষতি হইতেছিল, ঠিক সেই সময় উত্তর সীমানায় আর এক মহাবিপদ ঘটিল। ২৫এ আগষ্ট ১৬৬০ মুঘলেরা তাঁহার হাত হইতে বিখ্যাত চাকন-দুর্গ কাড়িয়া লইল।
১৬৫৯ খৃষ্টাব্দের শেষভাগে আওরংজীবের সিংহাসন নিষ্কন্টক হইল, ভ্রাতাদের বিরুদ্ধাচরণের আর কোন ভয় রহিল না, কারণ সর্ব্বত্রই তাঁহার জয় হইয়াছে। এইবার তিনি দাক্ষিণাত্যের দিকে দৃষ্টি ফিরাইবার অবকাশ পাইলেন। নিজ মাতুল শায়েস্তা খাঁকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করিয়া তাঁহাকে শিবাজীর বিরুদ্ধে পাঠাইলেন।
শায়েস্তা খাঁ যেমন বুদ্ধিমান তেমনি বীর; নেতৃত্বে ও দেশ-শাসনে সমান দক্ষ; বহু যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছেন। ধনে-মানে প্রভাব-প্রতিপত্তিতে এক মীরজুমলা ভিন্ন কেহই তাঁহার সমকক্ষ ছিল না। তিনি অতি চতুর প্রণালীতে আহমদনগর হইতে (২৫এ ফেব্রুয়ারি, ১৬৬০) কুচ করিয়া পুণা জেলার পূর্ব্ব ও দক্ষিণ দিক ঘুরিয়া, সন্মুখ হইতে মারাঠাদের ক্রমাগত তাড়াইয়া, এবং নিজের পশ্চাতের পথ নিরাপদ রাখিবার জন্য স্থানে স্থানে থানা বসাইয়া, অবশেষে পুণা শহরে আসিয়া পৌঁছিলেন (৯ই মে)। পথে তাঁহার কোন সৈন্য ক্ষয় হয় নাই বলিলেই চলে; মারাঠারা ভয়ে পিছাইয়া গেল, আর যদি-বা যুদ্ধ করিল এমন সুনিপুণভাবে চালিত ও দলবদ্ধ সৈন্যদলের সামনে দাঁড়াইতে পারিল না।
পুণার ১৮ মাইল উত্তরে চাকন-দুর্গ। ইহা হস্তগত করিতে পারিলে মুঘলরাজ্য হইতে দক্ষিণমুখী পথ দিয়া অতি সহজে পুণায় রসদ আনা সম্ভব হইবে। শায়েস্তা খাঁ ২১এ জুন চাকনের বাহিরে পৌঁছিয়া দুর্গ অবরোধ শুরু করিলেন। দুর্গস্বামী ফিরঙ্গজী নরসালা প্রাণপণে লড়িলেন। কিন্তু মুঘলেরা আজ অজেয়। জলকাদা অগ্রাহ্য করিয়া তাহারা দুর্গের চারিদিক খুঁডিয়া মুর্চা বাঁধিতে লাগিল, মাটির নীচ দিয়া দুর্গের দেওয়ালের তলা পর্য্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ করিয়া তাহাতে বারুদ ভরিয়া আগুন দিল (১৪ই আগষ্ট)। সশব্দে চাকন-দুর্গের উত্তর-পূর্ব্ব কোণের বুরুজ ফাটিয়া উড়িয়া গেল। আর সেই সুযোগে মুঘলেরা দুর্গপ্রাকার আক্রমণ করিয়া দুইদিন ধরিয়া মারামারি কাটাকাটির পর সমস্ত চাকন অধিকার করিল (১৫ই আগষ্ট)। শায়েস্তা খাঁ নিজে বীর, কাজেই বীরের আদর করিতে জানিতেন। তিনি ফিরঙ্গজীর গুণে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে বাদশাহী সৈন্যদলে উচ্চপদ দিতে চাহিলেন, কিন্তু প্রভুভক্ত মারাঠা নিমকহারাম হইতে অস্বীকার করিলেন। তখন তাঁহাকে সসম্মানে সৈন্যসহ শিবাজীর নিকট ফিরিয়া যাইতে দেওয়া হইল।