মাৱাঠাদের এই প্রথম কীর্ত্তি এখানেই থামিল না। বিজয়ী শিবাজী দক্ষিণে অগ্রসর হইয়া কোলাপুর জেলা আক্রমণ করিলেন, পন্হালা দুগ হস্তগত করিয়া (২৮এ নবেম্বর), রুস্তম্-ই জমানের অধীনে অপর একটি বিজাপুরী সৈন্যদলকে পরাস্ত করিলেন (২৮এ ডিসেম্বর)। আর তাহার পর জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ-কোঁকনে রত্নগিরি জেলায় প্রবেশ করিয়া অনেক বন্দর ও গ্রাম লুটিলেন।
আফজল খাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে গান ও গল্প
আফজল খাঁর ভীষণ পরিণাম দেশময় আলোচনা ও গল্পের সৃষ্টি করিয়াছিল। “অজ্ঞানদাস” ছদ্মনাম বা ভণিতাধারী একজন কবি মারাঠ ভাষায় এ ঘটনা সম্বন্ধে একটি অত্যন্ত তেজপূর্ণ পোবাড়া (ব্যালাড) রচনা করেন, তাহা এখনও জনসাধারণের খুব প্রিয়। আউন্ধের রাজা বালাসাহেব পন্ত প্রতিনিধি ইদানীং ঐ ঘটনা লইয়া একটি গীতিক_ লিখিয়াছেন। কিন্তু এই ‘ব্যালাড’ ঐতিহাসিক সত্য অনুসরণ করে নাই, শুধু সুখপাঠ্য কিংবদন্তী ও কাল্পনিক শাখাপল্লবে পূর্ণ,—যেন মহাভারতের একটি দ্বন্দ্বযুদ্ধ।
মারাঠা দেশে প্রবাদ আছে, যখন আফজল বিজাপুর হইতে শিবাজীর বিরুদ্ধে রওনা হন, তখন নানা অশুভ ঘটনা ঘটিয়াছিল—তাঁহার পতাকা ভাঙ্গিয়া পড়িয়া যায়, বড় হাতীটা অগ্রসর হইতে চাহে নাই, ইত্যাদি। আর তিনি মৃত্যু নিশ্চিত জানিয়া রওনা হইবার পূর্ব্বেই নিজের ৬৩ জন স্ত্রীকে খুন করিয়া একই চবুতরার নীচে সমান দূরে দূরে তাহাদের কবর দিয়া মনের শঙ্কা মিটাইয়াছিলেন। বিজাপুর শহরের কয়েক মাইল বাহিরে আফজলপুরা নামক স্থানে খাঁর বাড়ী ও চাকর-বাকরের বসতি ছিল। স্থানটি এখন জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত হইয়াছে; শুধু ভাঙ্গা দেওয়াল পরিখা ও বন-জঙ্গল ও দূরে চাষের ক্ষেত্র দেখা যায়। তাঁহার মৃত্যুর ১৪ বৎসর মাত্র পরে ফরাসী-পর্য্যটক আরে কারে ঐখানে আসিয়া দেখেন যে, কারিগরেরা খাঁর সমাধির পাথর কাটিতেছে এবং একখানা প্রস্তরফলকে খোদা আছে যে খাঁ তাঁহার হারেমের দুই শত স্ত্রীলোকের গলা কাটিয়া ফেলিয়াছিলেন। আমি ১৯১৬ সালের অক্টোবর মাসে তথায় যাই, এবং তেষট্টিটি কবর দেখিতে পাই। সেগুলি যে একই সময়ে এবং একই ধরনে গড়া তাহা নিঃসন্দেহে বুঝা যায়। এখনও স্থানীয় কৃষকগণ ঐ খুনের বিস্তারিত বিবরণ বলে এবং সেই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন স্থানগুলি দেখাইয়া দেয়।
- মারাঠী গাথায় আছে, তিনি তুলজাপুরের পর মানিকেশ্বর, পংঢারপুর, এবং মহাদেব পর্ব্বতেও দেবদ্বিজের প্রতি অত্যাচার অবমাননা করেন। শ্রীযুক্ত বিনায়ক লক্ষ্মণ ভাবে বলেন, এ কথা সত্য নহে।
০৪. পাঁচ বৎসর ধরিয়া যুদ্ধ, ১৬৬০-১৬৬৪
চতুর্থ অধ্যায় – পাঁচ বৎসর ধরিয়া যুদ্ধ, ১৬৬০-১৬৬৪
শিবাজীর দক্ষিণ-মহারাষ্ট্রে প্রবেশ
আফজল খাঁর মৃত্যু (১০ই নবেম্বর ১৬৫৯) এবং তাঁহার সৈন্যদল বিধ্বস্ত হইবার পর, শিবাজী দক্ষিণে কোলাপুর জেলায় প্রবেশ করিয়া দেশ লুঠিতে লাগিলেন। ২৮এ নবেম্বর তিনি পন্হালা নামক বিশাল গিরিদুর্গ অধিকার করিলেন। তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য স্থানীয় শাসনকর্ত্তা রুস্তম-ই-জমান বিজাপুররাজের আদেশে অগ্রসর হইলেন; আফজলের পুত্র ফজল খাঁ পিতৃহত্যার প্রতিশোধ লইবার জন্য রুস্তমের সহিত সসৈন্য মিলিত হইলেন। কিন্তু রুস্তম জানিতেন, বিজাপুরের কর্ত্রী-রাণী বড়ী সাহিবা গোপনে তাঁহার উচ্ছেদের চেষ্টায় আছেন, এ অবস্থায় তাঁহার আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় শিবাজীর সহিত সদ্ভাব বজায় রাখা;—বিশেষতঃ শিবাজীর বংশের সহিত তাঁহার দুই পুরুষ ধরিয়া বন্ধুত্ব। সুতরাং রুস্তম শিবাজীর সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া শুধু লোক দেখাইবার জন্য তাঁহার বিরুদ্ধে সৈন্য চালনা করিলেন। কোলাপুর শহর হইতে কিছু দূরে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হইল। রুস্তম গা ঢিলা দিয়া পিছনে থাকিলেন; ক্রুদ্ধ ফজল খাঁ যুদ্ধের সমস্ত ভার নিজের উপর লইয়া প্রবল বেগে মারাঠাদের আক্রমণ করিলেন (২৮এ ডিসেম্বর)। তাঁহার অনেক লোক যুদ্ধে মারা গেল, দু’হাজার ঘোড়া ও বারোটী হাতী ধরা পড়িল; পরাস্ত হইয়া ফজল খাঁ বিজাপুরে ফিরিলেন। আর রুস্তম পিছু হটিয়া নিজ জাগীর দক্ষিণ-কানাড়ায় গিয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলেন।
এই সুযোগে মারাঠারা সহ্যাদ্রি পার হইয়া পশ্চিম দিকে রত্নগিরি জেলায় ঢুকিয়া অবাধে দক্ষিণ-কোঁকনের শহর ও বন্দর লুঠিতে লাগিল। তাহাদের আর একদল পূর্ব্বদিকে অগ্রসর হইয়া বিজাপুর শহরের কাছাকাছি পৌঁছিল।
পনহালায় শিবাজীকে অবরোধ
তখন আদিল শাহর চৈতন্য হইল—তিনি শিবাজীকে দমন করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। সিদ্দি জৌহর নামক একজন হাব্শী ওমরাকে ‘সলাবৎ খাঁ’ উপাধি দিয়া ফজল খাঁর সহিত পনহালা দুর্গ দখল করিতে পাঠান হইল। পনের হাজার সৈন্যসহ জৌহর আসিয়া কোলাপুর শহরে আড্ডা গাড়িলেন এবং শিবাদীকে পনহালাতে অবরুদ্ধ করিলেন (২রা মার্চ, ১৬৬০)। কিন্তু তাঁহার মনে ছিল দুরভিসন্ধি। প্রভুর কাজে মন না দিয়া, তিনি নিজের জন্য স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। চতুর মারাঠা-রাজ ভবিষ্যতে সহায়তা করিবার লোভ দেখাইয়া জৌহরকে হাত করিলেন। লোক দেখাইবার ছলে ছয় মাস ধরিয়া ধীরে ধীরে ঐ দুর্গের অবরোধ-কার্য্য চলিতে লাগিল।
কিন্তু ফজল খাঁ ভুলিবার পাত্র নন। প্রতিশোধ লইবার জনা তিনি নিজ সৈন্যদল লইয়া ক্রমাগত মারাঠাদের আক্রমণ করিতে লাগিলেন। পনহালার পাশেই পবনগড় দুর্গ। নিকটস্থ একটি গিরিশৃঙ্গে কামান বসাইয়া ফজল খাঁ পবনগড়ের উপর গোলা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। পবনগড় রক্ষা করা দুর্ঘট হইল, কিন্তু একবার ইহা বিজাপুরীদের হাতে পড়িলে পনহালার পতনও অবশ্যম্ভাবী।