আফজল খাঁর সহিত কাটাকাটি
প্রতাপগড় দুর্গ শিখর হইতে নামিয়া শিবাজী তাঁহার তাঁবুর দিকে কিছু দূর ধীরে ধীরে যাইবার পর, হঠাৎ থামিয়া দাঁড়াইলেন এবং বলিয়া পাঠাইলেন যে, সৈয়দ বান্দাকে সাক্ষাতের স্থান হইতে সরাইয়া দিতে হইবে। তাহাই করা হইল। অবশেষে শিবাজী মিলনের শামিয়ানাতে প্রবেশ করিলেন। এই বস্ত্রগৃহে উভয় পক্ষেই চারিজন করিয়া লোক উপস্থিত ছিল—স্বয়ং নেতা, দুইজন শরীর-রক্ষক, এবং একজন ব্রাহ্মণ দূত। শিবাজী দেখিতে নিরস্ত্র, কিন্তু আফজল খাঁর কোমরে তলোয়ার ঝুলিতেছে।
সঙ্গীরা সকলে নীচে দাঁড়াইয়া রহিল। শামিয়ানার মধ্যস্থলে যে বেদীর মত অল্প উঁচু স্থানে আফজল খাঁ বসিয়াছিলেন, শিবাজী তাহার উপর চড়িলেন। খাঁ গদী হইতে উঠিয়া কয়েক পা অগ্রসর হইয়া শিবাজীকে আলিঙ্গন করিবার জন্য বাহ বিস্তার করিয়া দিলেন। শিবাজী বেঁটে ও সরু, তিনি বিশালকায় আফজলের কাধ পর্য্যন্ত উচু। সুতরাং খাঁর বাহু দুটি শিবাজীর গলা ঘিরিল। তারপর হঠাৎ আফজল খাঁ শিবাজীর গলা নিজ বাম বাহু দিয়া লৌহবেষ্টনে চাপিয়া ধরিলেন, এবং ডান হাত দিয়া কোমর হইতে লম্বা সোজা ছোরা (যম্ধর) খুলিয়া শিবাজীর বাম পাঁজরে ঘা মারিলেন। কিন্তু অদৃশ্য বর্ম্মে বাধিয়া ছোরা দেহে প্রবেশ করিতে পারিল না। গলার চাপে শিবাজীর দমবন্ধ হইবার মত হইল। কিন্তু এক মুহুর্ত্তে বুদ্ধি স্থির করিয়া তিনি বাম বাহু সজোরে ঘুরাইয়া আফজল খাঁর পেটে বাঘনখ বসাইয়া দিয়া তাঁহার পাকস্থলীর পর্দ্দা বিদীর্ণ করিয়া দিলেন, খাঁর ভুঁড়ী বাহির হইয়া পড়িল। আর, ডান হাতে ‘বিছুয়া’ লইয়া খাঁর বাম পাঁজরে মারিলেন। যন্ত্রণায় আফজল খাঁর বাহবন্ধন শিথিল হইয়া আসিল; এই সুযোগে শিবাজী নিজেকে মুক্ত করিয়া বেদী হইতে লাফাইয়া পড়িয়া নিজ সঙ্গীদের দিকে ছুটিলেন। এসব ঘটনা এক নিমেষে শেষ হইল।
ঘা খাইয়াই আফজল খাঁ চেঁচাইয়া উঠিলেন,—“মারিল, মারিল, আমাকে প্রতারণা করিয়া মারিল।” দুই দিক হইতে অনুচরগণ নিজ নিজ প্রভুর দিকে ছুটল। সৈয়দ বান্দা তাহার লম্বা সোজা তলোয়ার (পাট্টা) দিয়া এক কোপে শিবাজীর মাথার পাগড়ী কাটিয়া ফেলিল। তলোয়ারের ঘায়ে শিবাজীর পাগড়ীর নীচের লোহার টুপিটা পর্যন্ত টোল খাইয়া গেল, কিন্তু মস্তক রক্ষা পাইল। তিনি জীব মহালার হাত হইতে একখানি তলোয়ার লইয়া সৈয়দ বান্দাকে ঠেকাইতে লাগিলেন। মহালা পাশ কাটাইয়া আসিয়া প্রথমে সৈয়দের ডান হাত ও পরে মাথা কাটিয়া ফেলিল। ইতিমধ্যে বাহকেরা আহত আফজলকে পালকীতে শোয়াইয়া তাঁহার শিবিরে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু শম্ভুজী কাব্জী আসিয়া তাহাদের পায়ে কোপ মারায় তাহারা পালকী ফেলিয়া ছুট দিল। তখন শম্ভুজী আফজল খাঁর মাথা কাটিয়া বিজয়-গর্ব্বে তাহা শিবাজীর কাছে হাজির করিল।
আফজলের সৈন্য পরাজিত ও লুন্ঠিত হইল
আফজল খাঁর মৃত্যুর পর অমনি শিবাজী তাঁহার রক্ষী দুইটির সহিত দৌড়াইয়া পাহাড় বাহিয়া প্রতাপগড় দুর্গে উঠিলেন এবং সেখান হইতে তোপধ্বনি করিলেন। এই সঙ্কেত আগে হইতেই স্থির করা ছিল। তোপের শব্দ শুনিবামাত্র পার গ্রামের নিকট ঝোপ ও পর্ব্বতের মধ্যে যেখানে শিবাজীর দুই দল সেনা লুকাইয়াছিল, সেখান হইতে তাহারা বাহির হইয়া চারিদিক দিয়া বিজাপুরী সৈন্যদের আক্রমণ করিল। আফজলের আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদে তাঁহার শিবিরের কর্ম্মচারী সিপাহী ও লোকজন একেবারে হতভম্ব হইয়া গিয়াছিল। তাহাদের নেতা নাই, পথঘাট অপরিচিত, অথচ অগণিত শত্রু চারিদিক ঘিরিয়া আছে। পলাইবার পথ বন্ধ; সুতরাং, তাহারা হতাশ হইয়া যুদ্ধ করিল। কিন্তু মারাঠারা আজ বিজয়-উল্লাসে উন্মত্ত, দুইজন নামজাদা সেনাপতি তাহাদের চালনা করিতেছেন, যুদ্ধের স্থান তাহাদের সুপরিচিত। তাহারা অদম্য বেগে শত্রু বধ করিয়া অগ্রসর হইতে লাগিল। তিন ঘন্টার মধ্যে সব শেষ হইল। তিন হাজার বিজাপুরী সৈন্য মারা গেল। মাব্লেরা সামনে যাহা পাইল তাহারই উপর তরবারি চালাইতে লাগিল; পলাতক হাতীর লেজ কাটিয়া ফেলিল, দাঁত ভাঙ্গিয়া দিল,পা ঘাল্ করিল; উটকে কাটিয়া ভূমিশায়ী করিল। যে-সব বিজাপুরী সৈন্য পরাজয় স্বীকার করিয়া দাঁতে তৃণ থরিয়া ক্ষমা চাহিল, তাহাদের প্রাণদান করা হইল। এই যুদ্ধে শিবাজী লুঠ করিয়া বিশেষ লাভবান হইলেন। আফজল খাঁর সমস্ত তোপ, গোলাগুলি ও বারুদ, তাম্বু ও বিছানাপত্র, ধনরত্ন, মালসমেত ভারবাহী পশু তাঁহার হাতে পড়িল; ইহার মধ্যে ছিল পঁয়ষট্টিটা হাতী, চারি হাজার ঘোড়া, বারো শ’ উট, দু’হাজার কাপড়ের বস্তা, এবং নগদ ও গহনাতে দশ লক্ষ টাকা। বন্দীদের মধ্যে ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ বিজাপুরী সর্দ্দার, আফজলের দুই শিশুপুত্র, এবং দুজন সাহায্যকারী মারাঠা জমিদার। যে-সব স্ত্রীলোক শিশু ব্রাহ্মণ এবং শিবিরের চাকর ধরা পড়িল, শিবাজী তৎক্ষণাৎ তাহাদের মুক্তি দিলেন। কিন্তু আফজলের স্ত্রীগণ ও জ্যেষ্ঠপত্র ফজল্ খাঁ, কয়না নদীর তীর বাহিয়া খণ্ডোজী খোপ্ড়ে ও তাহার মাব্লে সৈন্যের সহায়তায় নিরাপদ স্থানে পলাইয়া গেলেন।
শিবাজী তাঁহার বিজয়ী সেনাদের একত্র করিয়া পরিদর্শন করিলেন। বন্দীদের অন্ন বস্ত্র ও অর্থ সাহায্য করিয়া নিজ নিজ স্থানে চলিয়া যাইতে দেওয়া হইল। যে-সব মারাঠা-সৈন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়াছিল, তাহাদের বিধবাদের পেন্সন দেওয়া হইল এবং বয়স্ক পুত্র থাকিলে তাহারা পিতার পদে নিযুক্ত হইল। আহত সৈনিকগণ জখমের অবস্থা অনুসারে একশত হইতে আটশত টাকা পুরস্কার পাইল, উচ্চ সৈনিক কর্ম্মচারীদিগকে হাতী, ঘোড়া, পোষাক ও মণিমুক্তা বক্শিশ দেওয়া হইল।