ইহার পর শিবাজী কল্যাণ ও ভিবণ্ডীর উত্তরে মাহুলী-দুর্গ দখল করিলেন (৮ জানুয়ারি, ১৬৫৮)। এইরূপে উত্তর-কোঁকন দখল করিয়া ক্রমে দক্ষিণ দিকে কোলাবা জেলার কিয়দংশ অধিকারে আনিলেন এবং তথায় অনেক দুর্গ নির্ম্মাণ করাইলেন। কল্যাণের উত্তরে পোর্তুগীজদের দমন প্রদেশের কয়েকটি গ্রাম লুঠ করিয়া শিবাজী আসিরি দুর্গে স্থায়িভাবে আড্ডা গাড়িলেন। আর, কল্যাণের নীচে সমুদ্রের বাড়ীতে জাহাজ নির্ম্মাণ করিয়া মারাঠী নৌসেনার সূত্রপাত করিলেন।
শিবাজীর দমনে আফজল খাঁর অভিযান
১৬৫৮ সালের প্রথমভাগে আওরংজীব দাক্ষিণাত্য হইতে চলিয়া গেলেন; তখন বিজাপুর-রাজ্য শান্তি ও নুতন বল পাইল। মন্ত্রী খাওয়াস্ খাঁ বেশ বিচক্ষণ লোক, আর রাজমাতা বড়ী সাহিবা অত্যন্ত তেজ ও দক্ষতার সহিত রাজকার্য্য চালাইতে লাগিলেন। চারিদিকে অবাধ্য সামন্তদিগকে দমন করিবার চেষ্টা চলিতে লাগিল। শাহজীকে হকুম করা হইল যে, তাঁহার বিদ্রোহী পুত্রকে বশে আনুন। তিনি উত্তর দিলেন-“শিবা আমার ত্যাজ্য পুত্র। আপনারা তাহাকে সাজা দিতে পারেন, আমার জন্য সঙ্কোচ করিবেন না।”
তখন শিবাজীর বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠান সাব্যস্ত হইল। কিন্তু ভয়ে কোনো ওম্রাহ এই সমর-অভিযানের নেতা হইতে সম্মত হইলেন না। সুলতান তখন দরবারের মধ্যে একটি পানের বিড়া রাখিয়া বলিলেন, “যিনি এই যুদ্ধের নেতা হইতে প্রস্তুত, কেবল তিনিই এই বিড়া তুলিয়া লইবেন এবং তাঁহাকে বীরশ্রেষ্ঠ বলিয়া গণ্য করা হইবে।”
আবদুল্লা ভটারি (পাচক-বংশীয়), উপাধি আফজল খাঁ, বিজাপুর রাজ্যের প্রথম শ্রেণীর ওম্রা; মহীশূর-জয়ে, এবং মুঘলদের সহিত গত যুদ্ধে তিনি অনেকবার বীরত্ব ও প্রভুভক্তি দেখাইয়া সুনাম অর্জ্জন করিয়াছেন। তিনিই পানের বিড়াটি খপ্ করিয়া উঠাইয়া লইলেন, এবং সগর্ব্বে বলিলেন যে, ঘোড়র উপর বসিয়া থাকিয়াই শিবাজীকে পরাস্ত করিয়া বাঁধিয়া লইয়া আসিবেন।
কিন্তু গত যুদ্ধের ফলে রাজসরকারের অর্থ ও লোকবল বড়ই কমিয়া গিয়াছে। কাজেই আফজলের সঙ্গে দশ হাজার অশ্বারোহীর বেশী সৈন্য পাঠান সম্ভব হইল না। এদিকে শিবাজীর অশ্বারোহী-সৈন্যই ত দশ হাজারের বেশী, তাহার উপর লোকে বলিত, জাবলীজয়ের ফলে তাঁহার অধীনে ষাট হাজার মাব্লে পদাতিক জুটিয়াছে। এ ছাড়া একদল সাহসী, রণদক্ষ পাঠান বিজাপুরের চাকরি হারাইয়া তাঁহার বেতনভোগী হইয়াছিল। সুতরাং বিজাপুরের রাণী-মা আফজলকে বলিয়া দিলেন,—“বন্ধুত্বের ভাণ করিয়া শিবাজীকে ভুলাইয়া বন্দী করিতে হইবে।” (তৎসাময়িক ইংরাজ-বণিকের চিঠিতে একথা স্পষ্ট লেখা আছে)।
আফজল খাঁর কার্য্যকলাপ
আফজল খাঁ বিজাপুর হইতে প্রথমে সোজা উত্তর দিকে অগ্রসর হইয়া মহারাষ্ট্রের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ তুলজাপুরে পৌঁছিয়া সেখানকার ভবানী-মূর্ত্তি ভাঙ্গিয়া জাঁতায় পিষিয়া গুঁড়া করিয়া ফেলিলেন।[১] তাহার পর পশ্চিম দিকে ফিরিয়া তিনি সাতারা শহরের ২০ মাইল উত্তরে বাই নামক নগয়ে পৌঁছিলেন (এপ্রিল ১৬৫৯)। এই নগরটি তাঁহার জাগীরে সদর ছিল। এখানে অনেক মাস থাকিয়া, কিরূপে শিবাজীকে পাহাড় হইতে খোলা জায়গায় আনা যায় অথবা স্থানীয় মারাঠা-জমিদারদের সাহায্যে বন্দী করা যায়, তাহার ফন্দী আঁটিতে লাগিলেন। বিজাপুর-সরকার অধীনস্থ সমস্ত মাব্লে দেশমুখদিগকে হুকুম পাঠাইয়াছিলেন, যেন তাঁহারা সৈন্য দিয়া আফজলের সহায়তা করেন। ইহার কিছু ফলও হইয়াছিল। রোহিড়খোরের দেশমুখী লইয়া খণ্ডোজী খোপ্ড়ে ও কান্হোজী জেধের মধ্যে ঝগড়া চলিতেছিল। কান্হোজী শিবাজীর পক্ষে ছিল। খণ্ডোজী আসিয়া আফজল খাঁর সহিত যোগ দিল এবং লিখিয়া অঙ্গীকার করিল যে, ঐ গ্রামের দেশমুখী তাহাকে দিলে সে শিবাজীকে ধরিয়া আনিয়া দিবে। খোপ্ড়েকে নিজ অনুচরসহ আফজলের সেনার অগ্রভাগের নেতা করা হইল।
বর্ষার শেষে অক্টোবর মাসে সৈন্যচালনা করিবার উপযুক্ত সময় আবার আসিবে। ইতিমধ্যে শিবাজী প্রতাপগড় দুর্গে পৌঁছিয়াছেন। এই দুর্গ বাই হইতে মাত্র ২০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। আফজল খাঁ নিজ দেওয়ান কৃষ্ণাজী ভাস্করকে দিয়া শিবাজীকে বলিয়া পাঠাইলেন,—“তোমার পিতা আমার বহুকালের বন্ধু, সুতরাং তুমি আমার নিকট অপরিচিত পর নহ। আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা কর, আমি বিজাপুরের সুলতানকে বলিয়া রাজী করাইর যাহাতে তোমার দুর্গগুলি ও কোঁকন প্রদেশ তোমারই আধিকারে থাকে। আমি দরবার হইতে তোমাকে আরও মান এবং সৈন্যের সরঞ্জাম দেওয়াইব। যদি তুমি স্বয়ং দররারে হাজির থাকিতে চাও, ভালই, উচ্চ সম্মান পাইবে। আর যদি তথায় উপস্থিত না হইয়া নিজ জাগীরে বাস করিতে চাও, তাহারও অনুমতি দিবার ব্যবস্থা করিব।”
আফজলের আক্রমণে শিবাজীর ভয় ও চিন্তা
ইতিমধ্যে আফজল খাঁর আগমন-সংবাদে শিবাজীর অনুচরগণের মধ্যে মহা ভয় ও ভাবনা উপস্থিত হইয়াছিল। তাহারা এ পর্য্যন্ত ছোটখাট লড়াই ও সামান্য পদের লোকজনের ধনসম্পত্তি লুটপাট করিয়াছে। এইবার একটি শিক্ষিত, সুসজ্জিত বিশাল বাহিনী একজন বিখ্যাত বীর সেনাপতির অধীনে তাহাদের বিরুদ্ধে লড়িতে আসিয়াছে, বিজাপুর হইতে বাই পর্য্যন্ত অপ্রতিহত তেজে অগ্রসর হইয়াছে, মারাঠারা তাহাদের বাধা দিতে মোটেই সাহস পায় নাই। আফজল এর অদম্য শক্তি ও নিষ্ঠুরতার গল্প দেশময় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে সেরা-দুর্গের জমিদার কস্তুরী রঙ্গ, বিজাপুরী সৈন্যের শিবিরে আফজল খাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করিতে আসিলে, আফজল তাঁহাকে ধরিয়া খুন করেন। সুতরাং শিবাজী প্রথম যেদিন নিজ প্রধানদের ডাকিয়া তাহাদের মত জানিতে চাহিলেন, সকলেই ভয়ে তাঁহাকে সন্ধি করিতে পরামর্শ দিল,বলিল—যুদ্ধ করিলে বৃথা প্রাণনাশ হইবে,জয়লাভ অসম্ভব।