কি ইতিমধ্যে শিবাজী মনে মনে ঠিক করিয়া ফেলিলেন যে, তিনি নিজের হইয়া পড়িবেন, মুঘলের পক্ষ হইয়া নহে। মুঘল-রাজ্য লুটিলেই তাহার লাভের সম্ভাবনা বেশী। এই ফন্দী গোপন রাখিয়া, পরামর্শ করিবার ভাণ করিয়া সোনাজীকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নিজের নিকট ফিরাইয়া আনিলেন। আর তাহার কিছুদিন পরেই মুঘল-অধিকৃত দাক্ষিণাত্যের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ (অর্থাৎ মহারাষ্ট্রের অংশ) হঠাৎ আক্রমণ করিলেন। সেখানে দিল্লীশ্বরের সৈন্যও কম ছিল, এবং সেনাপতিগণও অলস, অসতর্ক। মিনাজী ভোঁশলে ও কাশী-নামক দুইজন মারাঠা সর্দ্দার ভীমা নদী পার হইয়া মুঘলদের চামারগুণ্ডা ও রায়সীন্ পরগণায় গ্রাম লুটিয়া, আহমদনগর শহরের আশপাশে পর্য্যন্ত আতঙ্কের সৃষ্টি করিল। আর, শিবাজী স্বয়ং ৩০এ এপ্রিল অন্ধকার রাত্রে দড়ির সিঁড়ি বাহিয়া উত্তর-পুণা জেলায় জুন্নর নগরের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া রক্ষীদের বধ করিলেন। এখান হইতে তিন লক্ষ হোণ (বারো লক্ষ টাকা), দুইশত ঘোড়া এবং অনেক মূল্যবান গহনা ও কাপড় লুটিয়া লইয়া শিবাজী সরিয়া পড়িলেন।
আওরংজীবের সহিত সন্ধি
এই সংবাদ পাইয়া আওরংজীব ঐ অঞ্চলে অনেক সৈন্য পাঠাইলেন এবং স্থানীয় কর্ম্মচারীদের খুব শাসাইয়া দিলেন। আহমদনগরের দুর্গাধ্যক্ষ মুল্তফ খাঁ বাহিরে আসিয়া কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধের পর চামারা থানা হইতে মিনাজীকে তাড়াইয়া দিলেন। এদিকে, রাও কর্ণ ও শায়েস্তা খাঁ আসিয়া পড়ায় শিবাজী জুন্নর পরগণায় আর বেশীদিন থাকা নিরাপদ মনে করিলেন না। তিনি সরিয়া পড়িয়া আহমদনগর জেলায় ঢুকিলেন (মে মাসের শেষে)। কিন্তু এখানে আওরংজীব কর্ত্তৃক প্রেরিত সৈন্যদল লইয়া নসিরি খঁ দ্রুত কুচ করিয়া আসিয়া শিবাজীকে হঠাৎ আক্রমণ করিয়া প্রায় ঘিরিয়া ফেলিলেন (৪ঠা জুন)। মারাঠারা অনেকে মারা গেল, বাকী সকলে পলাইয়া প্রাণ বাঁচাইল।
তখন মুঘল-সেনানীরা নিজ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানার স্থানে স্থানে সসৈন্য বসিয়া দেশ রক্ষা করিতে লাগিলেন; আর মাঝে মাঝে দ্রুত মারাঠা-রাজ্যে ঢুকিয়া লুঠ করিয়া, গ্রাম পোড়াইয়া, প্রজা ও গরুবাছুর ধরিয়া আনিয়া আবার নিজ নিজ স্থানে ফিরিয়া আসিতে লাগিলেন। আওরংজীবের সুবন্দোবস্ত ও দৃঢ়শাসনে শিবাজী আর কোনই অনিষ্ট করিতে পারিলেন না। বর্ষা আরম্ভ হইল, দুই পক্ষই জুন জুলাই আগষ্ট মাস আপন আপন সীমানার মধ্যে বসিয়া কাটাইলেন।
সেপ্টেম্বর মাসে বিজাপুর-রাজ আওরংজীবের সহিত সন্ধি করিলেন। তখন শিবাজী আর কাহার বলে লড়িবেন? তিনি বশ্যতা স্বীকার করিয়া নসিরি খাঁর নিকট দূত পাঠাইলেন। খাঁ শিবাজীর প্রার্থনা যুবরাজকে জানাইলেন, কিন্তু কোনো সদুত্তর আসিল না। তাহার পর শিবাজী রঘুনাথ বল্লাল কোর্ডেকে সোজা আওরংজীবের নিকট পাঠাইলেন। যুবরাজ অবশেষে (জানুয়ারি ১৬৫৮) শিবাজীর বিদ্রোহ ক্ষমা করিয়া এবং মারাঠা প্রদেশে তাঁহার অধিকার স্বীকার করিয়া এক পত্র দিলেন; আর এদিকে শিবাজীও প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, তিনি মুঘল-সীমানা রক্ষা করিবেন, নিজের পাঁচশত অশ্বারোহী সৈন্য আওরংজীবের অধীনে যুদ্ধ করিবার জন্য পাঠাইবেন, এবং সোনাজী পণ্ডিতকে নিজ দূত করিয়া যুবরাজের দররারে রাখিবেন।
কিন্তু আওরংজীব সত্যসত্যই শিবাজীকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। তখন তিনি দিল্লীর সিংহাসন দখল করিবার জন্য উত্তর-ভারতে যাইতেছেন। দাক্ষিণাত্যে নিজ সৈন্যদিগকে শিবাজীর উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে বলিয়া গেলেন। মির জুম্লাকে লিখিলেন (ডিসেম্বর ১৬৫৭)-“নসিরি খাঁ চলিয়া আসায় ঐ প্রদেশটা খালি হইয়াছে। সাবধান, সেই ‘কুত্তার বাচ্চা সুযোগের অপেক্ষায় বসিয়া আছে।” আদিল শাহকে লিখিলেন-“এই দেশ রক্ষা করিও। শিবাজী এ দেশের কতকগুলি দুর্গ চুরি করিয়া দখল করিয়াছে। তাহাকে সেগুলি হইতে দূর করিয়া দাও। আর যদি শিবাজীকে চাকর রাখিতে চাও, তবে তাহাকে কর্ণাটকে জাগীর দিও,—যেন সে বাদশাহী রাজ্য হইতে দূরে থাকে এবং উপদ্রব বাধাইতে না পারে।”
শিবাজীর উত্তর-কোঁকন জয়
কিন্তু ১৬৫৮ ও ১৬৫৯ এই দুই বৎসর ধরিয়া মুঘল-রাজকুমারগণ সিংহাসন লইয়া যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায়, শিবাজীর ঐদিক হইতে কোনই ভয়ের কারণ রহিল না। আর গত যুদ্ধে মুঘলদের কাছে পরাজয় হইল কাহার দোষে,—এই লইয়া বিজাপুরী মন্ত্রী ও সেনাপতিদিগের মধ্যে তুমুল কলহ বাধিয়া গেল। প্রধান মন্ত্রী খাঁ মুহম্মদ রাজধানীতে খুন হইলেন। এই গণ্ডগোলের সুযোগে শিবাজী স্বচ্ছন্দে রাজ্য বিস্তার করিতে লাগিলেন। পশ্চিমঘাট (অর্থাৎ সহ্যাদ্রি পর্ব্বতমালা) পার হইয়া তিনি উত্তর-কোঁকন, অর্থাৎ, বর্ত্তমান থানা জেলায় ঢুকিয়া বিজাপুরের হাত হইতে কল্যাণ এবং ভিবণ্ডী নগর দুটি কাড়িয়া লইলেন; তথায় তাঁহার অনেক ধনরত্ন লাভ হইল (২৪ অক্টোবর, ১৬৫৭)।
বিজাপুরের অধীনে মুন্না আহমদ নামক একজন আরব ওম্রা এই কল্যাণ প্রদেশের শাসনকর্ত্তা ছিলেন। শিবাজীর সেনাপতি আবাজী সোনদেব ঐ দেশ অধিকার করিবার সময় মুল্লা আহমদের সুন্দরী তরুণী পুত্রবধূকে বন্দী করিলেন এবং শিবাজীর নিকট ভোগের উপহারস্বরূপ পাঠাইয়া দিলেন। কিন্তু শিবাজী বন্দিনীর দিকে একবারমাত্র চাহিয়া বলিলেন, “আহা! আমার মা যদি এর মত হইতেন, তবে কি সুখের বিষয় হইত। আমার চেহারাও খুব সুন্দর হইত।” এইরূপে মেয়েটিকে মা বলিয়া ডাকিয়া আশ্বস্ত করিয়া তাহাকে বস্ত্র অলঙ্কার-সমেত বিজাপুরে তাহার শ্বশুরের নিকট সসম্মানে পাঠাইয়া দিলেন। সেই যুগে ইহা এক নূতন ঘটনা,—শুনিয়া সকলে আশ্চর্য্য হইল।