ছফা ভুরু কুচকে তাকালো। আতরের বলা জ্বলজ্বলে চোখের ব্যাখ্যা কি তাহলে এই? “কিভাবে ভয় দেখাতেন?” আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো সে।
“খুব সহজেই…” বলেই মুচকি হাসলো। প্রথমে যখন এখানে আসি। তখন থেকেই টের পেলাম আশেপাশের মানুষজন আমার ব্যাপারে খুব আগ্রহী। রাত-বিরাতে দেয়াল টপকে বাড়ির ভেতরেও ঢু মারে কেউ কেউ। তো, হ্রট করে মনে হলো একটা কাজ করা যেতে পারে আমার এক বান্ধবী আছে…ও নাটক-সিনেমায় অভিনয় করে। ওকে একবার ডাইনির চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছিলাম…এটা দেখে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ওর মাধ্যমে একজোড়া কসমেটিক কন্ট্যাক্ট লেন্স জোগাড় করলাম। ওই লেন্সটা রাতের বেলায় জ্বলজ্বল করে। রেডিয়াম আর কি।”
ছফা কিছু বলতে গিয়েও বললো না। কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে সে এই ব্যাখ্যাটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিলো। এছাড়া আর কীই-বা হতে পারে?
“বলতে পারেন, ওই লেন্স দুটো দারুণ কাজে দিয়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। বুঝতে পারছে, সার্ভিল্যান্স ক্যামেরায় আতরকে দেয়াল টপকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে মুশকান জুবেরি রেডিয়াম কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে বসেছিলো বেলকনিতে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, ঐ ইনফর্মারকে ঘাবড়ে দেয়া। তখন মহিলা ইচ্ছে করেই রেডওয়াইন পান করছিলো আতরের কাছে ওটা যেনো রক্ত বলে মনে হয়।
“কিন্তু এরফলে গ্রামের লোকজন যে আপনাকে ডাইনি বলে সন্দেহ করতে শুরু করেছে তা কি আপনি জানেন?”
মুচকি হাসলো মিসেস জুবেরি। “সমস্যা কি? ওরা যা খুশি ভাবুক আমার উদ্দেশ্য তো খুব সহজ, কেউ যেনো আমার ত্রি-সীমানায় না আসে। সেটা ভয় থেকে হোক কিংবা অন্য কিছু, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
“বুঝেছি,” বললো ছফা। “একজন ডাইনি, যার সাথে এমপি, ডিসি, এসপি’র দারুণ খাতির…তাকে কেউ ঘাঁটাতে যাবে না। দূর থেকে শুধু ডাইনি বলে দুটো মন্দ কথা বলবে।”
“ঠিক,” মাথা নেড়ে সায় দিলো মুশকান জুবেরি।
“কিনতু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, আপনার বাড়িতে এক মেয়ে। আছে, সে আমাকে সামনাসামনি দেখেও কিছু বলে নি। মানে, একটু ভয় পাওয়া…চিৎকার দেয়া..এসব কিছুই করে নি।”
প্রচ্ছন্ন হাসি দেখা গেলো মুশকানের ঠোঁটে। ছফার প্রশ্নগুলো যেনো খুব উপভোগ করছে। “আসলে ওই মেয়েটা আপনাকে দেখতেই পায় নি…দেখতে পেলে অবশ্যই চিৎকার দিতো।”
“কি বলেন…মেয়েটা আমাকে অবশ্যই দেখেছে!” জোর দিয়ে বললো।
“ওই মেয়েটা আমার সাথেই থাকে। আপনাদের ভাষায় কাজের মেয়ে…আমি অবশ্য বলি, হোম-অ্যাসিসটেন্ট।” একটু থেমে কানের পাশে চুলগুলো সরিয়ে দিলো এবার। “সাফিনা ছোটোবেলা থেকেই রাতকানা রোগে ভুগছে। খুব গরীব ঘরের মেয়ে..অপুষ্টি থেকে এটা হয়ে গেছে। দিনের বেলায় সব দেখতে পেলেও রাতে তেমন দেখে না বললেই চলে।”
ছফা হা-করে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
দারোয়ান বোবা, কাজের মেয়ে রাতকানা, জ্বলজ্বলে চোখের আসল কারণ রেডিয়াম কন্ট্যাক্ট লেন্স, মাটিচাপা দেয়া হয়েছে ঘরে বানানো রেডওয়াইন, সার্ভিল্যান্স ক্যামেরার সাহায্যে অনেক কিছুই দেখতে পায় মহিলা, শখের কুমীর চাষ শুরু করেছে ইদানিং।
মাথার মধ্যে এসব কিছু ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে তার সমস্ত সন্দেহ, প্রশ্ন বিশাল এক গহবরে মুখ থুবরে পড়তে যাচ্ছে। সে কি তাহলে ভুল মানুষের পেছনে ছুটছে?
“আর কিছু জানতে চান না?”
মুশকানের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো সে। “আপনি কি জানেন, আজ দুপুরে একটা ঘটনা ঘটেছে সুন্দরপুরের বড় কবরস্তানে?” প্রসঙ্গটা মনে পড়তেই জিজ্ঞেস করলো সে। “ঐ যে ফালু..সে একজনকে মেরে জীবন্ত কবর দেবার চেষ্টা করেছিলো, ভাগ্য ভালো, লোকটা প্রাণে বেচে গেছে।”
কপালে ভাঁজ পড়লো মুশকান জুবেরির। “তাই নাকি?”
“হুম। ঘটনার পর থেকে ফালুকে পাওয়া যাচ্ছে না। কবরস্তানে তার ঘর তল্লাশী করেছে পুলিশ.. কিছুই পায় নি।”
“ওর ঘর থেকে কী পাবার আশা করেছিলেন, আপনি? মানে পুলিশ?” স্থিরচোখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো ছফা। “লাশ।”
মুশকানের কপালের ভাঁজ আরো প্রকট হলো। চোখে তার বিস্ময় মাখানো প্রশ্ন। মাথাটা ডানপাশে একট কাত হয়ে গেলো।
“আমাদের কাছে ইনফর্মেশন ছিলো, ওর ঘরের খাটের নীচে কঙ্কাল আছে।”
“কঙ্কাল দিয়ে ও কি করে?”
“জানি না কি করে, তদন্ত হলে সব বেরিয়ে আসবে।”
নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মুশকান জুবেরি, তবে সেটা ক্ষণিকের জন্যে। “আপনি কি ওর ঘটনার সাথে আমাকেও সন্দেহ করছেন?”
কাঁধ তুললো সে। “আমি আপাতত আপনার ব্যাপারেই মনোযোগ দিচ্ছি..ফালুর ঘটনাটা পরে দেখা যাবে। ওটা স্থানীয় পুলিশ-”।
“আমার কি ব্যাপার?” কথার মাঝখানে বলে উঠলো মুশকান। “একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?”
গভীর করে নিঃশ্বাস নিলে নুরে ছফা। “বলছি।” কথাগুলো গুছিয়ে নেবার জন্য একটু সময় নিলো সে। মিসেস জুবেরি এখনও তার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে আছে। “আমি আসলে একজন মানুষের নিখোঁজ হবার কেস তদন্ত করছি আর সেটা করতে গিয়েই আপনার সন্ধান পেয়েছি।”
মুশকান অভিব্যক্তিহীন চোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না?”
“হাসিব আহমেদ নামের এক ভদ্রলোক তিনমাস আগে নিখোঁজ হয় ঢাকা থেকে। তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় নি এখন পর্যন্ত। ঐ কেসটা পুলিশ, সিআইডি ঘুরে ডিবির কাছে আসে..বর্তমানে ওটার তদন্ত করছি আমি।”