“উনার আসার কথা ছিলো নাকি?” আগ্রহী হয়ে উঠলো ছফা।
স্থিরচোখে চেয়ে থেকে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন বৃদ্ধ, তারপর গম্ভীরকণ্ঠে বললেন “…ছিলো, কিন্তু উনি আসেন নি।”
“কেন আসেন নি?”
গভীর করে দম নিয়ে নিলেন সুন্দরপুরের বৃদ্ধমাস্টার। “অলোকনাথের বাবা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক মানুষ। তাদের মধ্যে জানাশোনাও ছিলো। এক জমিদারের সাথে আরেক জমিদারের সম্পর্ক থাকাটাই তো স্বাভাবিক।” একটু কেশে নিলেন তিনি। “শুনেছি, অলোকনাথের বাবা। ত্রিলোকনাথ বসু রবীন্দ্রনাথকে সুন্দরপুরে আসার নেমন্ত্রণ করেছিলেন। কবির জন্য বিশাল আয়োজন করেছিলেন তিনি। ঢাকা আর লক্ষৌ থেকে বাবুর্চি এনে রান্না-বান্নাও করেছিলেন হরেকরকম পদের। নিজের বাড়িটাও সাজিয়েছিলেন…আয়োজনে কোনো কমতিই ছিলো না কিন্তু একেবারে শেষমুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়ে দেন তিনি আসতে পারছেন না।”
“উনি…মানে রবীন্দ্রনাথ কেন আসলেন না? কারণটা কি ছিলো?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাস্টার। “এটা ১৯১৮ সালের ঘটনা। যেদিন উনি রওনা দেবেন তার আগের দিন উনার বড়মেয়ে মাধুরিলতা মারা যায়।”
“ও,” আস্তে করে বললো ছফা।
“সম্ভবত মিসেস জুবেরি এই গল্পটা রাশেদের কাছ থেকে শুনে থাকবেন…তাই অমন অদ্ভুত নাম দিয়েছেন।”
মাস্টারকে চুপ মেরে যেতে দেখে ছফা উঠে দাঁড়ালো। তার দেখাদেখি আতরও। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। বলার মতো আর কিছু নেই বৃদ্ধের। “আপনাকে ধন্যবাদ,” বললো সে। “অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার। ভালো থাকবেন। নমস্কার।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন বৃদ্ধ। ছফা আর আতর কয়েক পা এগোতেই পেছন থেকে আস্তে করে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে বলে উঠলেন, “আমার কাছে মিথ্যে বলার দরকার ছিলো না।”
চমকে উঠলো তারা দুজন। মাস্টারের ঘোলা দু-চোখ যেনো জ্বলজ্বল করছে। তারা কিছু বলার আগেই বৃদ্ধ বলে উঠলেন আবার :
“আমি মিথ্যে কথা একদমই পছন্দ করি না।” ছফা কিছু বলতে যাবে অমনি তিনি হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। “কিছু বলতে হবে না। আপনি কে, কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন সে-সব জানার কোনো আগ্রহ নেই আমার।”
তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। একটু শব্দ করেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। কয়েক মুহূর্ত দরজার কপাটের দিকে ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো ছফা। দরজার পাশে চেয়ারের উপরে রাখা হারিকেনের আলোয় একটা লেখা পড়ার চেষ্টা করলো সে। “উনার নামটা যেনো কি?”
তবে আতর আলী মুখ খোলার আগেই লেখাটা পড়তে পারলো সে।
.
অধ্যায় ৭
রমাকান্তকামার!
অন্ধকারে বিড়বিড় করে উঠলো ছফা।
টাউনে ফিরে যাচ্ছে তারা, তবে শর্টকাট পথ ছেড়ে, কবরস্তানটি এড়িয়ে ঘুরপথে যাচ্ছে এখন।
ছফা জানে রমাকান্ত একটি নাম, যেমন রজনীকান্ত, সজনীকান্ত। কিনতু কামার নিশ্চয় পদবী-টাইটেল। ওটা নামের থেকে আলাদা করেই লেখে সবাই। সম্ভবত মাস্টার নিজের নামটাকে আরেকট বৈশিষ্টপূর্ণ করার জন্য রমাকান্ত আর কামারের মাঝখানে কোনো ফাঁক রাখেন নি। ফলে নামটি উল্টো করে বললে কিংবা লিখলে একই থাকে! এটাও কি এক ধরণের অ্যাম্বিগ্রাম? ছফা নিশ্চিত হতে পারলো না।
মাথা থেকে রমাকান্তকামার বিদায় করে দিয়ে আতর আলীর বয়ানের দিকে মনোযোগ দিলো সে। বিসতৃত ধানক্ষেতের আইল ধরে এগিয়ে যেতে যেতে মুশকান জুবেরির আগমনের গল্পটি বলে যাচ্ছে ইনফর্মার। গল্পটি ছফাকে বেশ আগ্রহী করে তুললো।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অলোকনাথ বসুর সম্পত্তিগুলো সরকার অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে নিয়ে নিলেও ওগুলো মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভোগ-দখলেই ছিলো। ২০০৮ সালের দিকে মুশকান জুবেরি সম্পত্তিগুলো নিজের অধিকারে নিয়ে নেয় খুব সহজে কারণ রাজনীতিবিদদের জন্য ওই সময়টা ছিলো খুবই কঠিন। তবে ২০০৯ সালে মিলিটারি চলে যাবার পর আস্তে আস্তে রাজনীতিকেরা আবার ফিরতে শুরু করে, তখন ঝামেলা বেঁধে যায়। পুনরায় বেদখল হয়ে যায় কিছু সম্পত্তি। অবশেষে স্থানীয় এমপির সাথে একটা বোঝাঁপড়া করে নেন ভদ্রমহিলা, ফলে কিছু সম্পত্তি ফিরে পান। সেই সম্পত্তির পরিমাণও নেহায়েত কম নয়।
ভদ্রমহিলা এখানে এসেই সরাসরি জমিদার বাড়িতে উঠলেন। সেটা ২০০৮ সালের ঘটনা। অলোকনাথ বসুর বাকি সম্পত্তিগুলোও তিনি নিজের দখলে নিয়ে দেখভাল করতে শুরু করলেন। ব্যাপারটা সুন্দরপুরে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলেও এ-নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি কেউ, কারণ স্থানীয় এমপি মহিলাকে সব ধরণের সাহায্য করেছেন। এই সাহায্য মোটেও নিঃস্বার্থ ছিলো না, বিনিময়ে বোসবাবুর সম্পত্তির বিরাট একটি অংশ লাভ করেন তিনি। যেসব সম্পত্তি দেবোত্তর করে দিয়েছিলেন সেগুলোর প্রায় সবটা চলে গেছে এমপির পকেটে, বাকি যে সম্পত্তিগুলেী জুবেরির নামে লিখে দিয়েছিলেন সেগুলো পেয়ে যায় ঐ মহিলা।
“খালি জমি না, এহন ঐ বেটিরেও ভোগ-দখল করবার চায় এমপিসাব,” বেশ রসিয়ে রসিয়ে বললো আতর।
তারা এখন বিসতৃর্ণ ক্ষেত পেরিয়ে একটা ডোবার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একটুখানি খামতি নিয়ে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে জ্বলজ্বলে চাঁদ। প্রায় পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নার আলোয় প্লাবিত চারপাশ।
“উনাকে ভোগ-দখল করতে চায় মানে?” ছফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।