টুনি বলল, “বুঝতে পারছি তুই শুধু কবি না, তুই একটা পাগলি মেয়ে। তোকে দেখে-শুনে রাখতে হবে।”
মিলা হি হি করে হাসল। টুনি কবিতার খাতার পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল, “এইখানে তোর প্রিয় কবিতা কোনটা?”
মিলা বলল, “মানুষের মন নিয়ে একটা কবিতা আছে।”
টুনি কবিতাটা বের করে পড়ল, তারপর মাথা নেড়ে বলল “ফার্স্ট ক্লাস। এখন তুই একটা কাগজে সুন্দর করে এই কবিতাটা লিখে ফেল।”
“কেন টুনি আপু?”
“আগে লিখে দে তারপর বলব।”
মিলা তার ঝকঝকে হাতের লেখায় কবিতাটা কপি করতে থাকে। টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “এখন আমাকেও একটা কবিতা লিখতে হবে।”
মিলা হাততালি দিয়ে বলল, “তুমি কবিতা লিখবে? বাহ্! কী মজা।”
টুনি বলল, “আগেই এত খুশি হোস না। এর মাঝে কোনো মজা নেই।”
“তুমি কী নিয়ে কবিতা লিখবে টুনি আপু?”
“তোর কোনো আইডিয়া আছে?”
“তুমিও মানুষের মন নিয়ে লিখো না কেন?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু, আমি লিখব রসগোল্লা নিয়ে।”
“রসগোল্লা?” মিলা আবার হি হি করে হাসতে থাকে।
টুনি তখন অনেক সময় লাগিয়ে রসগোল্লা নিয়ে কবিতা লিখল :
বড় ভাই কাড়া, ছোট বোন কাড়ি
বাবা আনল রসগোল্লা আস্ত এক হাঁড়ি
কাড়া বলল আমি খাব, কাড়ি বলে আমি
তারপর কাড়াকাড়ি করল কাড়াকাড়ি।
কবিতাটা পড়ে হাসতে হাসতে মিলার চোখে পানি এসে গেল, বলল, “টুনি আপু, তুমি খুবই ফানি। তোমার কবিতা তোমার থেকেও ফানি।”
টুনি বলল, “এটা মোটেও আমার অরিজিনাল কবিতা না-আমি কি নিজে লিখতে পারি নাকি? ছোট থাকতে হাসাহাসি নিয়ে একটা কবিতা পড়েছিলাম, সেটা থেকে নকল করে এটা বানিয়েছি।”
টুনি দুটি কবিতা আলাদা করে রেখে দুটি কাগজ নিল। একটা মিলাকে দিয়ে বলল, “তুই এখানে লেখ, শিশু-কিশোর সাহিত্য প্রতিযোগিতা, তার নিচে লেখ আমি এই প্রতিযোগিতার জন্যে একটা কবিতা পাঠাচ্ছি। তারপর নিচে তোর নাম, ক্লাস, রোল নাম্বার এইসব লেখ।”
মিলা ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন টুনি আপু? আমি মোটেই আর ওদের কাছে কবিতা পাঠাব না। কোনোদিনও পাঠাব না।”
টুনি বলল, “আমি জানি। তোকে তোর কবিতা পাঠাতে হবে না।”
“তাহলে কেন লিখব?”
“একটু পরেই বুঝতে পারবি কেন লিখছিস।”
মিলা মুখ ভার করে লিখল। তখন টুনি নিজের হাতে অন্য কাগজটিতে একই কথা লিখল, নিচে টুনি তার নাম, ক্লাস, রোল নম্বর এইসব লিখল।
টুনি তারপর দুটি খাম বের করল, তারপর বলল, “ধরা যাক তুই আর আমি এই প্রতিযোগিতায় দুইটা কবিতা পাঠাব বলে ঠিক করেছি। ধরা যাক দুইজনে একসাথে বসে দুইটা খামে চিঠি আর কবিতা ভরতে গিয়ে গোলমাল করলাম! তাহলে কী হবে?”
মিলা বলল, “কী হবে?”
“তোর সুন্দর কবিতাটা যাবে আমার নামে! আর আমার ফালতু কবিতাটা যাবে তোর নামে।”
“হ্যাঁ। তাহলে কী হবে?”
“সেটা আমি এখনো জানি না। কিন্তু তুই এত সুন্দর কবিতা লিখিস যে তোর কবিতাটা পুরস্কার পেতেও পারে! কিন্তু এবারে পুরস্কারটা আসবে আমার নামে। আমি যেহেতু ক্লাস ওয়ানে পড়ি না, তাই পুরস্কারটা আমাকে দিয়ে দেবে। আরেকটা খারাপ চিঠি লিখবে না।”
“তাহলে কী হবে?”
“তাহলে পুরস্কার নেওয়ার জন্যে আমাকে স্টেজে ডাকবে-আমি স্টেজে উঠে বলব, ভুল করে তোর কবিতাটা আমার খামে ঢুকে গেছে! আসল পুরস্কারটা পাওয়ার কথা তোর। তখন তোকে স্টেজে ডাকতে হবে-তুই যখন স্টেজে যাবি তখন একটা বিশাল হাউকাউ লেগে যাবে।”
“হাউকাউ?”
“হ্যাঁ। তখন তুই আর আমি মিলে স্টেজে দাঁড়িয়ে সবকিছু বলে দেব। উচিত শিক্ষা হবে তাদের।”
“আর যদি পুরস্কার না পাই?”
“তাহলে অবশ্য কিছু করার নেই। আমরা তখন গোড়া থেকে নতুন একটা কিছু শুরু করব। অন্য একটা প্ল্যান। সেটা হবে প্ল্যান বি। সেটাও যদি না হয় তাহলে শুরু করব প্ল্যান সি। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিশোধ না নিচ্ছি ততক্ষণ চলতেই থাকবে।”
.
টুনিকে অবশ্যি প্ল্যান বি কিংবা সিতে যেতে হলো না, কারণ দুই সপ্তাহ পর টুনি একটা চিঠি পেল, সেখানে লেখা জুনিয়র ক্যাটাগরিতে কবিতা প্রতিযোগিতায় সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আরো দুই সপ্তাহ পরে পুরস্কার বিতরণী। তাকে পুরস্কার নেওয়ার জন্যে ওই দিন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে থাকতে বলেছে।
মিলার সামনে টুনি অনেক সাহস দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে খুব নার্ভাস। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সে যে নাটকটা মঞ্চস্থ করবে বলে ঠিক করেছে, সেটাতে আসলেই তারা ঠিক ঠিক করে অভিনয় করতে পারবে কি? যদি না পারে তখন কী হবে?
.
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে টুনি আর মিলা সময়মতো এসে দর্শকদের সিটে মাঝামাঝি বসে আছে। এই অনুষ্ঠানে মিলাকে আনতে গিয়ে টুনিকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। টুনি ছোটাচ্চুকে নিয়ে মিলার বাসায় গিয়ে মিলার আব্বু-আম্মুকে অনেক কিছু বুঝিয়ে মিলাকে এনেছে। বেশ বড় একটা হলঘরে এখন তারা বসে আছে। এখানে সব মিলিয়ে কয়েকশ মানুষ বসতে পারে। আজকে অবশ্যি বেশিরভাগই কমবয়সী বাচ্চাকাচ্চা। কমবয়সী বাচ্চাকাচ্চা বেশি থাকলে যা হয় এখানে তাই হচ্ছে। সবাই কিচিরমিচির করে কথা বলছে।
টুনি স্টেজটার দিকে তাকিয়ে ছিল, বসার জন্যে সেখানে বেশ কয়েকটা চেয়ার রাখা আছে। সামনে টেবিল, সেই টেবিলে পুরস্কার সাজানো। পুরস্কার হিসেবে মেডেল এবং বই দেয়া হবে। বইগুলো রঙিন ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা আছে। স্টেজটাও খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, পিছনে বিশাল একটা ব্যানার, সেখানে বড় বড় করে লেখা “নতুন পৃথিবী ম্যান্ডারিন ক্রোকারিজ শিশু-কিশোর সাহিত্য প্রতিযোগিতা”, পাশে অতিথিদের নাম। অনুষ্ঠানের সময় বলা হয়েছিল বিকাল পাঁচটা, এখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে, তবুও অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। কখন শুরু হবে কে জানে! মিলার সামনে টুনি একটা সাহসী ভাব ধরে রাখলেও ভেতরে ভেতরে সে অসম্ভব নার্ভাস।