ছোটাচ্চু বসার ঘরে সোফায় বসে মারিয়া আর তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আপনাদের কয়েকটা ছবি দেখাই। আমি জানি এ রকম ছবি কারো বিশ্বাস হবার কথা নয় কিন্তু ছবিগুলো সত্যি।”
ছোটাচ্চুর গলার মাঝে কিছু একটা ছিল, যেটা শুনে মারিয়া আর তার স্বামী দুজনেই ভয় পেয়ে গেল। শুকনো মুখে বলল, “কীসের ছবি?”
“আপনাদের বাচ্চা বুবাই কোথায়?”
“ভেতরে। মর্জিনার কাছে।”
ছোটাচ্চু বলল, “তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসবেন, প্লিজ?”
মারিয়া মর্জিনাকে ডেকে বলল, “মর্জিনা, বুবাইকে দিয়ে যাও আমার কাছে।”
মর্জিনা বুবাইকে নিয়ে বাইরের ঘরে এলো। মারিয়া হাত বাড়িয়ে বুবাইকে নেওয়ার চেষ্টা করল। বুবাই মর্জিনাকে শক্ত করে ধরে রাখল, মারিয়ার কাছে আসতে চাইল না। শেষ পর্যন্ত একরকম জোর করে তাকে নিজের কোলে নিল। মর্জিনা সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, ছোটাচ্চু মর্জিনার দিকে
তাকিয়ে বলল, “আপনি একটু ভেতরে যাবেন, প্লিজ?”
মর্জিনা খুব অনিচ্ছার সাথে ভেতরে গেল। এ রকম সময়ে টুনি ফিরে এলো; ছোটাচ্চু বললেন, “টুনি দরজাটা বন্ধ করে দে।”
টুনি দরজা বন্ধ করে ছোটাচ্চুর পাশে এসে বসল। ছোটাচ্চু তার ক্যামেরার পিছনের স্ক্রিনে সকালে তোলা ছবিগুলো একটা একটা করে বের করে দেখাতে দেখাতে বলল, “এই যে দেখেন, আজকে সকালে আপনার বাসার গেটে ছবিগুলো তোলা হয়েছে। আপনারা দুজন কাজে বের হয়ে যাচ্ছেন। তার এক ঘণ্টা পর মর্জিনা আপনাদের ছেলেকে কোলে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।”
মারিয়া চমকে উঠে বলল, “বুবাইকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?”
ছোটাচ্চু দেখালেন, “এই যে আপনাদের ছেলে। রাস্তার ফুটপাথে। ভিক্ষা করানোর জন্যে বসিয়ে দিয়েছে।”
মারিয়া আর তার স্বামী কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, “কী বলছেন আপনি?”
“হ্যাঁ, আমি শুধু বলছি না। আপনাদের দেখাচ্ছি–”
মারিয়া হঠাৎ চিলের মতো চিৎকার করে ডাকল, “মর্জিনা মর্জিনা–”
মর্জিনা বেশ শান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। একটা হাত আঁচলে ঢাকা, হাতে মনে হয় কিছু আছে। টুনি একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই হঠাৎ যে ঘটনাটা ঘটল সেটার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। মর্জিনা একটা ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে মারিয়ার কাছ থেকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বুবাইকে টেনে নিজের কাছে। নিয়ে নিল।
সবাই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তখন মর্জিনা হিংস্র গলায় বলল, “খবরদার কেউ কাছে আসবে না।” মর্জিনা এক হাতে বুবাইকে কোলে নিয়ে অন্য হাতটি আঁচলের নিচ থেকে বের করে আনল। সেই হাতে কোনো মারাত্মক অস্ত্র নেই, খুবই সাধারণ একটা ললিপপ। বুবাই ললিপপ দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, হাত বাড়িয়ে সেটা ধরতে চায়, কিন্তু মর্জিনা ললিপপটা বুবাইয়ের হাতে দিল না, তার মুখের সামনে একটু দূরে ধরে রাখল।
মারিয়া চিৎকার করে বলল, “কী হচ্ছে?”
মর্জিনা শান্ত গলায় বলল, “এই কাঠি লজেন্সটা ইন্দুর মারার বিষের মাঝে চুবাইয়া আনছি। আপনেরা একটু তেড়িবেড়ি করেন তো বুবাইয়ের মুখের মাঝে ঢুকাইয়া দিমু।”
মারিয়া চিষ্কার করে বলল, “কী বলছ তুমি?”
“ঠিকই বলছি। সবাই চুপ করে বসেন।”
সবাই আবার সোফায় বসল। মারিয়ার স্বামী কাঁপা গলায় বলল, “তুমি ভাবছ তুমি পার পেয়ে যাবে?”
“আগে অনেকবার পার পাইছি, কাজেই, মনে হয় এইবারও পার পাইমু। আর আমি যদি পার না পাই, তাহলে আপনাদের বাচ্চাও পার পাইব না। এই বাচ্চা আপনাদের চিনে না, আমারে চিনে।”
ছোটাচ্চু বলল, “কী চাও তুমি?”
মর্জিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর দৃষ্টিতে বিষ ঢেলে বলল, “দুপুরবেলা যখন ক্যামেরা নিয়ে আপনি খালি আমার পাশে দাঁড়াইয়া বাস-ট্রাকের ছবি তুলবার লাগছিলেন, তখনই আমার সন্দেহ হইছিল, কার ছবি তুলেন, বাস-ট্রাকের, না আমার?”
ছোটাচ্চু কিছু বলল না, মর্জিনা টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ছেমড়ি, পাকঘরে যাও। দেখো টেবিলের উপর একটা ব্যাগ আছে। ব্যাগটা নিয়া আসো। খবরদার কোনোরকম টেংরিবাজি করবা না।”
টুনি কোনো টেংরিবাজি করল না, রান্নাঘরে গিয়ে দেখল একটা ব্যাগ। টুনি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয়ে এলো। উঁকি দিয়ে দেখল, ব্যাগের ভেতর সোনাদানা, অলংকার, টাকা-পয়সা। মর্জিনা এগুলো অনেক দিন থেকে জমা করেছে।
মর্জিনা বলল, “ব্যাগটা একেকজনের সামনে নিয়ে ধরো। আর আপনারা ব্যাগের মধ্যে আপনাদের মোবাইল টেলিফোনটা রাখেন।”
মারিয়ার স্বামী আপত্তি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, মর্জিনা তখন একটা ধমক দিল; বলল, “খবরদার কোনো কথা নাই। আমার হাতে সময় নাই।”
টুনি একেকজনের সামনে ব্যাগটা নিয়ে ধরল এবং সবাই তার মোবাইল ফোন ব্যাগের মাঝে রাখল। টুনি ব্যাগটা মর্জিনার হাতে দেয়। মর্জিনা খুশি হয়ে বলল, “চমৎকার! এখন আপনারা আর কাউকে ফোন করতে পারবেন না।”
মর্জিনার কোলে বুবাই আশেপাশে তাকাল, কী হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। ললিপপটা খাবার জন্যে সে ব্যস্ত হয়ে সেটা ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মর্জিনা বলল, “এইবারে আমি যাচ্ছি। বাচ্চাটারে নিচে দারোয়ানের কাছে দিয়া যামু। সাথে নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল। বাচ্চাটা খালি জন্ম দিছেন আর কিছু করেন নাই। মানুষ যা করার আমি করছি।”
মর্জিনা দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, “বাসার চাবিটা দেন।”