ছোটাচ্চু তখন তার ক্যামেরা নিয়ে নেমে গেল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রাস্তার বাস, গাড়ি, স্কুটার, টেম্পোর ছবি তোলার ভান করে সে বুবাই আর তার কাছাকাছি বসে থাকা মর্জিনার অনেকগুলো ছবি তুলে নেয়। টুনি যেহেতু মারিয়ার বাসায় গিয়েছে এবং মর্জিনা তাকে দেখেছে তাই সে কাছাকাছি গেল না। দূরে স্কুটারের ভেতর বসে রইল।
বুবাই বেশ তাড়াতাড়ি টাকা রোজগার করতে থাকে। সামনে দিয়ে গেলেই সে হাত পাতে এবং সবাই বুবাইকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে এবং অনেকেই তাকে টাকা-পয়সা দেয়। বুবাই তখন মানুষটাকে তার মাড়ি বের করে একটা হাসি উপহার দেয়। নোটটা সে দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখে। এবং মর্জিনা কাছে এলে মর্জিনার হাতে তুলে দেয়।
বুবাই ফুটপাথে বসে বসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফুটপাথ থেকে ময়লা তুলে মাঝে মাঝে মুখে দেয়, স্বাদটা পছন্দ হলে খেয়ে ফেলে, পছন্দ না হলে থু করে ফেলে দেয়। টুনি একধরনের আতঙ্ক নিয়ে দেখল বুবাই একটা সিগারেটের গোড়া মুখে দিয়ে দিল, মাড়ি দিয়ে চিবিয়ে স্বাদটা পছন্দ না হওয়ায় মুখটা বিকৃত করে থু থু করে ফেলে দিল। কাছেই মর্জিনা নিরাসক্ত ভাবে বসে আছে, বুবাই কী মুখে দিচ্ছে, কী করছে, সে ব্যাপারে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।
ছোটাচ্চুর সন্দেহ সত্যি। এলাকাটা কিছু মানুষ কন্ট্রোল করে। মর্জিনার সাথে ভাগ-বাটোয়ারার ব্যবস্থা আছে। টুনি দেখল একসময় ডাকাতের মতো চেহারার একজন এসে মর্জিনার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে গেল।
.
দুপুরবেলা ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে একটা ফার্স্টফুডের দোকানে খেতে গেল। টুনি একটা হামবার্গার খেতে খেতে বলল, “আমার খুব খারাপ লাগছে ছোটাচ্চু।”
ছোটাচ্চু তার হামবার্গারে বড় একটা কামড় দিয়ে বলল, “কেন?”
“বুবাই রৌদ্রের মাঝে বসে ভিক্ষা করছে আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।”
“করতে পারছি না কে বলেছে? ইচ্ছা করে কিছু করছি না। এখন কিছু করার চেষ্টা করলে সবগুলো পালিয়ে যাবে। সে জন্যে অপেক্ষা করছি।”
টুনি কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “পাজি মেয়ে মানুষটা বুবাইকে কিছু খেতে দিবে কি না কে জানে! বুবাইয়ের খিদে পেয়েছে। ফুটপাথ থেকে তুলে তুলে ময়লা খাচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম একটা সিগারেটের বাঁট মুখে দিল!”
ছোটাচ্চু বলল, “ওটা নিয়ে চিন্তা করিস না। বুবাই ফুটপাথে থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মনে হয় সিগারেটের বাঁটও হজম করে ফেলবে। আর মর্জিনা নিশ্চয়ই বুবাইকে কিছু খাওয়াবে, তার বিজনেসের জন্যে খাওয়াতে হবে!”
টুনি বলল, “তা ঠিক।”
ফার্স্টফুডের দোকান থেকে বের হয়ে দুজনেই দূর থেকে বুবাইকে লক্ষ করল। ভিক্ষা করে করে সে নিশ্চয়ই কাহিল হয়ে গেছে। এখন সে শক্ত ফুটপাথের উপর উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। প্রচণ্ড রোদ, মাছি ভনভন করছে কিন্তু তাতে বুবাইয়ের কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হলো না।
ছোটাচ্চু আর টুনি আশেপাশে থেকে মর্জিনাকে আর বুবাইকে চোখে চোখে রাখল। তিনটার দিকে মর্জিনা তার ব্যবসা গুটিয়ে নিল। বুবাইকে কোলে তুলে নিয়ে মোড়ের টংয়ের কাছে গিয়ে কয়েকজন মানুষের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল, মনে হলো কোনো একধরনের লেনদেন হলো। তারপর সে বাসায় রওনা দিল। প্রথমে বাস, তারপর রিকশা এবং শেষ অংশ পায়ে হেঁটে।
মর্জিনার বাসায় ঢোকার পর টুনি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “যাক বাবা, বাসায় ফিরে এসেছে।”
ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করব?”
“মারিয়া আর তার হাজব্যান্ড বাসায় ফিরুক, তখন গিয়ে আমরা কথা বলব। মর্জিনাকে আটকাতে হবে। তার কাছ থেকে খবর নিয়ে পুরো গ্যাংটাকে ধরতে হবে।”
“আমরা এখন কোথায় অপেক্ষা করব?”
“বাসা থেকে ঘুরে আসতে পারি। মারিয়া আর তার হাজব্যান্ড কখন বাসায় আসবে কে জানে! রাস্তাঘাটে যা ট্রাফিক জ্যাম, অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে নিশ্চয়ই দুই-তিন ঘণ্টা লেগে যায়।”
.
সন্ধেবেলা ছোটাচ্চু আর টুনি মারিয়ার বাসায় ফিরে এলো। স্কুটার থেকে নেমে ছোটাচ্চু জসীমকে বলল, “জসীম, তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমরা কাজ সেরে আসি।”
জসীম বলল, “কোনো সমস্যা নাই। আমি আছি।”
টুনি ছোটাচ্চুকে মারিয়ার ফ্ল্যাটের সামনে নিয়ে এলো, বেল বাজাতেই মারিয়ার স্বামী দরজা খুলে দিল। ছোটাচ্চু বলল, “আমার নাম শাহরিয়ার, আমি একটা দরকারি কাজে এসেছিলাম। আমাকে আপনি চিনবেন না, আমার মা’কে চিনবেন। পরশু রাতে আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন।”
গলার স্বর শুনে মারিয়াও বের হয়ে এলো; টুনিকে দেখে সে চিনতে পারল; মুখে হাসি ফুটিয়ে ছোটাচ্চুকে বলল, “আসেন। শুনেছিলাম আপনি অনেক বড় ডিটেকটিভ অফিস দিয়েছেন—“
ছোটাচ্চু কিছু বলল না, টুনিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। টুনি দেখল পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে মর্জিনা ছোটাচ্চুকে দেখছে। দুপুরবেলা ছোটাচ্চু তার ক্যামেরা দিয়ে মর্জিনার পাশে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তুলেছে। মর্জিনা কি ছোটাকে চিনে ফেলেছে?
টুনি দাঁড়িয়ে গেল, ছোটাচ্চুকে বলল, “ছোটাচ্চু তুমি কথা বলো, আমি এক্ষুনি আসছি।”
“কই যাচ্ছিস?”
“নিচে, জসীম ভাইয়ের কাছে। স্কুটারে একটা বই ফেলে এসেছি, নিয়ে আসি!”
ছোটাচ্চু একটু অবাক হলো, বের হওয়ার সময় টুনির হাতে বই ছিল সেটা মনে করতে পারল না। তবে এটাও সত্যি, টুনির কাজকর্ম বোঝা মুশকিল।