“আপনি পারমিশান দিলেন না, স্কুটার দিয়ে ধাক্কা দিয়ে শালার দুইটা ঠ্যাং ভেঙে দিতাম, ছয় মাস হাসপাতালে থাকলে একেবারে সিধা হয়ে যেত।”
ছোটাচ্চু কোনো কথা বলল না। স্কুটারের ভেতর টুনি ছোটাচ্চুর পাশে বসার পর জসীম দরজা বন্ধ করে দিল। খাঁচার মতো এই স্কুটারগুলো খুবই অদ্ভুত, স্কুটারওয়ালা যখন বন্ধ করে দেয় তখন প্যাসেঞ্জার আর নিজে থেকে দরজা খুলতে পারে না! কোনো প্যাসেঞ্জার কোনোদিন সেটা নিয়ে আপত্তি করে না, কারণটা কী?
জসীম তার স্কুটার চালিয়ে রওনা দিল; কোথায় যেতে হবে কিছুই বলতে হলো না; টুনি অনুমান করল, আগে থেকেই বলে দেয়া আছে।
সত্যি সত্যি জসীম তার স্কুটার চালিয়ে মারিয়ার বাসার এলাকায় চলে এলো। বাসা থেকে খানিকটা দূরে রাস্তার পাশে জসীম তার স্কুটার থামাল, বলল, “এসে গেছি স্যার।”
ছোটাচ্চু টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “কোন বাসাটা মনে আছে?” “হ্যাঁ।” টুনি মাথা নাড়ল। “কালো গেট।”
কাজেই কালো গেট থেকে কে কে বের হয় সেটা দেখার জন্যে তিনজনই অপেক্ষা করতে থাকে।
.
অফিস টাইমের কাছাকাছি সময়, তাই আশেপাশের প্রায় সব বাসা থেকেই লোকজন কাজে যাবার জন্যে বের হতে শুরু করেছে। টুনি দেখল একসময় একটা অফিসের দামি মাইক্রোবাস এসে থামল এবং মারিয়ার স্বামী কোট টাই পরে বের হয়ে সেই মাইক্রোবাসে উঠে অফিস গেল। তার কিছুক্ষণ পর বাসা থেকে একটা বড় গাড়ি বের হয়ে এলো, সেই গাড়িতে মারিয়া বসে আছে, সে অফিস যাচ্ছে।
এরপর প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। একটা স্কুটারের ভেতর এক ঘণ্টা। বসে থাকা সোজা কথা নয়, তাই মাঝে মাঝে টুনি আর ছোটাচ্চু স্কুটার থেকে বের হয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল। টুনি ভেবেছিল অপেক্ষা করতে করতে ছোটাচ্চু বুঝি বিরক্ত হয়ে যাবে, কিন্তু ছোটাচ্চু মোটেও বিরক্ত হলো না। টুনি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, তুমি বিরক্ত হচ্ছ না তো?”
“না। একটা কাজে এসেছি, বিরক্ত হব কেন?”
“যদি দেখা যায় আমার সন্দেহটা মিথ্যা তাহলে তুমি আমার উপর রাগ হবে না তো?”
“রাগ হব কেন? খুশি হব। বাচ্চাটা সেফ আছে, ক্রিমিনালদের হাতে নেই জানলে রাগ হব কেন?”
টুনি একটু হাসল; বলল, “আগে তোমার মোটেই ধৈর্য ছিল না! ডিটেকটিভ হওয়ার পর অনেক ধৈর্য বেড়েছে।”
ছোটাচ্চু একটু হাসল; বলল, “সেটা তুই ভুল বলিসনি! আমার ডিটেকটিভ কাজের নব্বই ভাগ হচ্ছে কারো বাড়ির সামনে, না হলে কারো অফিসের সামনে বসে অপেক্ষা করা।”
দুজন যখন কথা বলছিল তখন সত্যি সত্যি মর্জিনা বুবাইকে কোলে নিয়ে বের হয়ে এলো। বাসার কাজের মহিলা একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়, বাসার দারোয়ানের তাকে থামানোর কথা। কিন্তু বাসার দারোয়ান তাকে থামাল না, বরং দেখা গেল দারোয়ান আর মর্জিনা দুজন একটু কথা বলল। শুধু তা-ই নয়, মর্জিনা তার কোমরে গুঁজে রাখা একটা নোট বের করে দারোয়ানের হাতে দিল। বোঝাই যাচ্ছে দুজনের মাঝে একধরনের বোঝাবুঝি আছে।
ছোটাচ্চু নিচু গলায় বলল, “টুনি, তোকে কগ্র্যাচুলেশন। তুই সত্যি সত্যি একটা বিরাট বড় কেস সলভ করেছিস।”
টুনি উত্তেজিত হয়ে বলল, “আগে পুরোটা দেখে নিই।”
ছোটাচ্চু জসীমকে বলল, “জসীম, এই মহিলাকে ফলো করতে হবে।”
জসীম বলল, “কোনো সমস্যা নাই।”
মর্জিনা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে থাকে। ছোটাচ্চু আর টুনি তখন স্কুটারে উঠে বসল। ছোটাচ্চু স্কুটারের ভেতর থেকে বুবাই আর মর্জিনার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিল।
মর্জিনা আরেকটু সামনে গিয়ে একটা রিকশায় উঠল। রিকশাটা রাস্তা ধরে এগোতে থাকে; জসীম একটু দূর থেকে রিকশাটার পিছু পিছু তার স্কুটার নিয়ে যেতে থাকে। জসীম অনেক দিন থেকে ছোটাচ্চুর সাথে কাজ করে আসছে, তাই কখন কী করতে হবে খুব ভালো জানে।
বড় রাস্তায় এসে মর্জিনা রিকশাটাকে ছেড়ে দিয়ে বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রথম দুটি বাস ছেড়ে দিয়ে মর্জিনা তিন নম্বর বাসটাতে উঠে পড়ল। জসীম তখন বাসটার পিছু পিছু যেতে থাকে, কাজটা সহজ নয় কিন্তু টুনি দেখল জসীম খুব ভালোভাবে বাসটার পিছু পিছু যাচ্ছে।
শহরের ঠিক মাঝখানে এসে মর্জিনা বুবাইকে কোলে নিয়ে নেমে পড়ল। ছোটাচ্চু আর টুনি স্কুটারের ভেতর বসে থেকে মর্জিনা কী করে সেটা লক্ষ করে। তারা দেখল মর্জিনা মোড়ের একটা টংয়ের ভেতর বসে থাকা একটা মানুষের সাথে কথা বলল, মানুষটা তখন আঙুল দিয়ে ব্যস্ত রাস্তার পাশে ফুটপাথে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল। মর্জিনা সেখানে একটা ময়লা কাপড় বিছিয়ে বুবাইকে বসিয়ে দিল; টুনি অবাক হয়ে দেখল বুবাই সাথে সাথে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতে থাকল। দেখে মনে হলো ভিক্ষা করার ব্যাপারটা বুবাইয়ের বেশ পছন্দ, তার কাছে সেটা একটা খেলার মতো।
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু।”
ছোটাচ্চু বলল, “বল।”
“এখন মর্জিনাকে ধরা উচিত না?”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না। এখানে মনে হয় বড় গ্যাং কাজ করছে। আমরা কিছু করতে চাইলে পুরো গ্যাং মনে হয় নেমে যাবে।”
“তাহলে?”
“আগে কাছে থেকে কয়েকটা ছবি তুলি।”
“ছবি তুললে সন্দেহ করবে না?”
“না। আমার লেন্সে একটা আয়না লাগানো আছে। একদিকের ছবি তোলার ভান করে অন্যদিকের ছবি তোলা যায়।”