রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ভিখিরিদের লক্ষ করছিল; তখন সে একজন কম বয়সী মহিলাকে দেখতে পেল। ময়লা একটা শাড়ি পরে একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটা গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাটি ছোট কিন্তু কী মায়াকাড়া চেহারা! মা যে রকম হাত পেতে ভিক্ষা করছে ছোট বাচ্চাটিও সে রকমভাবে হাত পাতছে! মা’কে দেখে এই গেন্দা বাচ্চাটাও ভিক্ষা করা শিখে গেছে।
টুনি হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। মারিয়ার বাচ্চা বুবাই ঠিক এভাবে হাত পেতেছিল! টুনি ভালো করে তাকাল, না এটি মারিয়ার বাচ্চা বুবাই না, অন্য কোনো বাচ্চা। টুনি দেখল একজন গাড়ির কাঁচ নামিয়ে একটি ময়লা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল, বাচ্চাটা খপ করে নোটটা হাতে নিয়ে নেয়, তারপর হাতটা তার মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয়। মা নোটটি নিয়ে বাচ্চাটিকে আদর করে এবং বাচ্চাটি মাড়ি বের করে রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে হাসল। ঠিক বুবাইয়ের মতন।
এই মাটি যে রকম তার বাচ্চাকে নিয়ে ভিক্ষে করছে মারিয়ার বাসার মর্জিনা কি একইভাবে বুবাইকে নিয়ে ভিক্ষে করে? সে জন্যেই কি বুবাইয়ের গায়ের রং রোদে পুড়ে কালো হয়েছে?
টুনি ভালো করে আবার মহিলাটি আর বাচ্চাটির দিকে তাকাল। সত্যিই কি এই বাচ্চাটি এই মহিলার? নাকি এই বাচ্চাটিও বুবাইয়ের মতো একটি বাচ্চা?
টুনি বেশিক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, স্কুলে দেরি হয়ে যাবে। সে রাস্তা পার হয়ে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। কিন্তু মাথা থেকে চিন্তাটাকে সরাতে পারে না।
.
সন্ধেবেলা টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে গেল। ছোটাচ্চু বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছে। টুনিকে দেখে ছোটাচ্চু বই পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করল, “কী খবর টুনি?”
টুনি বলল, “কোনো খবর নাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “খবর না থাকলেই ভালো। খবর মানেই যন্ত্রণা।”
“খবর নাই কিন্তু প্রশ্ন আছে।”
ছোটাচ্চু বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাল, বলল, “সাত।”
“সাত?”
“হ্যাঁ।”
“সাত কী?”
“তোর প্রশ্নের উত্তর।”
টুনি বলল, “তুমি আমার প্রশ্নটাই শুনোনি, একটা উত্তর দিয়ে দিলে!”
“প্রশ্ন না শুনেই উত্তর দিতে হয়। প্রশ্ন শুনলে হয়তো দেখব উত্তরটা জানি না।”
টুনি বলল, “আমি তোমাকে যে প্রশ্নটা করব তুমি তার উত্তর জানেনা।”
“ঠিক আছে, কর প্রশ্ন।”
“তুমি কি একটা ডিটেকটিভ কাজ করবে?”
ছোটাচ্চু বইটা পেটের উপর রেখে বলল, “ডিটেকটিভ কাজ?”
“হ্যাঁ।”
“উঁহু। আমার এজেন্সি নাই, আমি কী কাজ করব? তোদের বলেছি না, আমি ডিটেকটিভ কাজ ছেড়ে দিব।”
“তুমি তাহলে কী করবে?”
“এখনো ঠিক করি নাই। বই লিখতে পারি।”
“কী বই?”
ছোটাচ্চু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “ডিটেকটিভ বই।”
টুনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি শেষ একটা ডিটেকটিভ কাজ করে দেবে?”
“তুইও তো ডিটেকটিভ। তুই করিস না কেন?”
“আমি পারলে করতাম, কিন্তু আমি পারব না।”
“কেন পারবি না?”
“আমি ছোট সেই জন্যে। কেউ করতে দেবে না।”
ছোটাচ্চু চুপ করে রইল। টুনি বলল, “তুমি এই কাজটা করে দাও, যদি দেখা যায় আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা সত্যি, তাহলে অনেক বড় কাজ হবে।”
ছোটাচ্চু তবুও মুখ সুচালো করে বসে রইল। টুনি বলল, “প্লিজ ছোটাচ্চু। প্লিজ।”
ছোটাচ্চু শেষ পর্যন্ত বলল, “ঠিক আছে, বল। শুনি কী কাজ।”
টুনি তখন ছোটাচ্চুকে মারিয়ার ছেলে বুবাইয়ের কথা বলল, তার সন্দেহ হচ্ছে মারিয়ার বাসার কাজের মহিলা মর্জিনা বাচ্চাটাকে নিয়ে ভিক্ষে করতে বের হয়। মারিয়াদের বাসার সামনে অপেক্ষা করলেই দেখা যাবে মর্জিনা আসলেই বাচ্চাটাকে নিয়ে বের হচ্ছে কি না। যদি বের হয় তাহলে পিছু পিছু গেলেই দেখা যাবে বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় যায়, কী করে। খুবই সহজ-সরল কেস। কিন্তু টুনির স্কুলে যেতে হয় তাই সে এটার সমাধান করতে পারবে না। অন্যদের করতে হবে।
ছোটাচ্চু খানিকক্ষণ চিন্তা করল; তারপর বলল, “আমি তোর কেসটা নিতে পারি কিন্তু তুইও থাকিস আমার সাথে।”
টুনির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “আমাকে নেবে সাথে?”
“হ্যাঁ। তোর কেস তুই না থাকলে কেমন হবে? আমি তোর আম্মুকে বলে স্কুলে না যাওয়ার পারমিশান নিয়ে রাখব। এক দিন স্কুলে না গেলে কিছু হবে না।”
.
পরদিন খুব সকালে ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো। সাথে একটা ক্যামেরা, তার লেন্স যথেষ্ট লম্বা। টুনি যে স্কুলে না গিয়ে ছোটাচ্চুর সাথে যাচ্ছে, অন্য বাচ্চারা সেটা টের পায়নি, টের পেলে একটা হুলস্থূল লাগিয়ে দিত।
টুনি বের হয়ে দেখল বাসার সামনে একটা স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে। ছোটাচ্চুকে দেখে স্কুটারের ড্রাইভার স্কুটার থেকে নেমে একটা লম্বা সালাম দিল; বলল, ‘ভালো আছেন স্যার?”
“হ্যাঁ ভালো আছি জসীম। তোমার খবর কী?”
“আমার খবর আর কোথা থেকে হবে, আপনি আমাকে আর ডাকেন, জীবন খুবই পানসে!”
ছোটাচ্চু হাসার চেষ্টা করল; বলল, “কাজ ছেড়ে দিয়েছি, তোমাকে আর ডেকে কী করব!”
জসীম নামের স্কুটার ড্রাইভার তার স্কুটারের দরজা খুলে দিতে দিতে বলল, “আপনি কাজ ছাড়েন নাই স্যার, ওই বদমাইশের বাচ্চা আপনার কোম্পানি দখল করে নিয়েছে।”
ছোটাচ্চু স্কুটারে উঠতে উঠতে বলল, “নিয়েছে তো নিয়েছে, সমস্যা কী?”