মারিয়া প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, “না না, কিছু দিতে হবে না। শুধু মন থেকে দোয়া করে দেন। তাহলেই হবে।”
দাদি বললেন, “দোয়া তো সবসময়েই করি।”
তারপর এক হাতে বুবাইকে ধরে রেখে অন্য হাতে ব্যাগটা খুলে একটা পাঁচশ’ টাকার নোট বের করে বললেন, “মা, তোমরা বড়লোক মানুষ, তোমাদের বাচ্চাকে ভালো কিছু দেওয়ার ক্ষমতা তো আমার নাই। এই যে এই টাকাটা দিয়ে আমার দাদুকে একটু চকোলেট কিনে দিও!”
দাদি নোটটা বের করার সাথে সাথে বুবাই খপ করে নোটটা ধরে ফেলল। তারপর সেটা টেনে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। দাদি থতমত খেয়ে বললেন, “মারিয়া, তোমার ছেলের খুব বুদ্ধি! সে বুঝে ফেলেছে এটা দিয়ে তার জন্যে চকোলেট কিনে দেবে। সে জন্যে আগেই নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে।”
মারিয়া ভুরু কুঁচকে তার ছেলের দিকে তাকাল, তারপর হাত পেতে বলল, “বুবাই, ছিঃ! এটা দিয়ে দাও।”
বুবাই নোটটা মারিয়ার হাতে দিতে রাজি হলো না। শক্ত করে নিজের বুকের কাছে ধরে রেখে মর্জিনার দিকে তাকিয়ে আঁ আঁ করে ডাকতে লাগল।
মর্জিনা একটু অপ্রস্তুত হয়ে কাছে এগিয়ে আসতেই বুবাই নোটটা মর্জিনার দিকে এগিয়ে দেয়। মর্জিনা নোটটা হাতে নিতেই বুবাই তার মাড়ি বের করে মর্জিনার দিকে তাকিয়ে হাসল, যেন সে অনেক বড় একটা কাজ করেছে।
মর্জিনা নোটটা নিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া হাত বাড়িয়ে নোটটা নিতে চাইল কিন্তু বুবাই আঁ আঁ করে চিৎকার করে আপত্তি জানাল, তাই নোটটা মর্জিনার হাতেই থাকল।
মারিয়া মুখ শক্ত করে মর্জিনাকে ভেতরে গিয়ে একটু চা-নাশতা নিয়ে আসতে বলল। বুবাই মর্জিনার সাথে ভেতরে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু মারিয়া যেতে দিল না, নিজের কোলে রেখে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকল।
মারিয়া একটু ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলল, “বাচ্চাটা মর্জিনাকে খুব পছন্দ করে। আগে একেবারে খেতে চাইত না, মর্জিনা আসার পর খাওয়া নিয়ে কোনো ঝামেলা করে না।”
দাদি বললেন, “ও।”
মারিয়া বলল, “জন্মের সময় গায়ের রং খুব ফর্সা ছিল, এখন দেখি আস্তে আস্তে কালো হয়ে যাচ্ছে।”
দাদি বললেন, “পুরুষ মানুষ গায়ের রং দিয়ে কী করবে?”
টুনি আপত্তি করে বলতে চাইছিল মেয়েরাই বা গায়ের রং দিয়ে কী করবে? কিন্তু নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে টুনি কিছু বলল না, চুপ করে রইল।
দাদি বললেন, “একটা বাচ্চা সুস্থ থাকাটাই বড় কথা।”
মারিয়া বলল, “মাশাআল্লাহ্, বাচ্চা আমার সুস্থই আছে। এর বয়সী অন্য বাচ্চারা কেমন জানি লুতুপুতু হয়, আমার বুবাই শক্ত-সমর্থ।”
দাদি বললেন, “বাহ্।”
বুবাই থেকে আলোচনা অন্যান্য বাচ্চাদের দিকে ঘুরে গেল। সেখান থেকে বাচ্চাদের বড় করার সমস্যা। সেখান থেকে লেখাপড়া। সেখান থেকে শিক্ষাব্যবস্থা। সেখান থেকে রাজনীতি-একবার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হবার পর আর থামাথামি নেই।
ততক্ষণে মারিয়ার স্বামীও চলে এসেছে। কমবয়সী বড়লোকদের যে রকম চেহারা হবার কথা ঠিক সে রকম চেহারা, থুতনিতে তিনকোনা একধরনের স্টাইলের দাড়ি। আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু ব্যবসা-বাণিজ্য ইমপোর্ট, ডলার, ইউরো এগুলো।
একসময়ে মর্জিনা নাশতা নিয়ে এলো। মোটেও অখাদ্য হালুয়া নয়, চিকন চিকন স্যান্ডউইচ, পনিরের স্লাইস এবং সন্দেশ। সাথে দার্জিলিং চা।
দাদি যখন বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্যে উঠলেন তখন মারিয়া আর তার তিনকোনা স্টাইলের দাড়িওয়ালা স্বামী শুধু নিচে নামিয়ে দিল না, তাদের ঢাউস গাড়িতে তুলে ড্রাইভারকে পৌঁছে দিতে বলল। ড্রাইভার বিরস মুখে
টুনি আর দাদিকে বাসায় পৌঁছে দিল। গাড়ি থেকে নেমে দাদি তার ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে ড্রাইভারকে চা খাওয়ার জন্যে দিলেন। “না
লাগবে না আন্টি, লাগবে না”, বলতে বলতে ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল।
বাসার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে দাদি বললেন, “বুঝলি টুনি, মারিয়ার বাচ্চাটা নিয়ে কিছু একটা গোলমাল আছে। গোলমালটা কী ধরতে পারছি না।”
টুনি বলল, “বড়লোকের বাচ্চাদের মনে হয় এ রকম গোলমাল থাকে।”
দাদি বললেন, “উঁহু। বড়লোকের বাচ্চার গোলমাল না। বড়লোকের বাচ্চারা এ রকম হয় না। মারিয়া বলেছে বাচ্চাটা কালো হয়ে যাচ্ছে,
আসলে কালো হচ্ছে না।”
“তাহলে কী হচ্ছে?”
“রোদে পুড়ে রং এ রকম হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা বাসায় থাকে, বাচ্চার গায়ের রং রোদে পুড়বে কেন?”
দাদির কথাটা শুনে টুনির ডিটেকটিভ মন পুরোদমে কাজ করতে শুরু করল। কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পেল না।
.
দুদিন পর বাচ্চারা সবাই মিলে স্কুলে যাচ্ছে। সবাই মোটামুটি একসাথে রওনা দেয়, তারপর যেতে যেতে একেকজন একেক রাস্তায় ভাগ হয়ে যায়। টুনির স্কুলটা সবচেয়ে দূরে, এতটুকু দূরত্ব কেউ হেঁটে যায় না। কিন্তু টুনির হেঁটে যেতে খুব ভালো লাগে, তাই সে সুযোগ পেলেই হেঁটে হেঁটে যায়। রাস্তায় তখন কত রকম মানুষকে দেখতে পায়। একেকজন মানুষ একেক রকম, একেকজন একেকভাবে কথা বলে, হাঁটে, ঝগড়া করে! টুনি মনে হয় শুধু মানুষগুলোকে দেখে দেখেই একটা জীবন পার করে দিতে পারবে।
টুনির স্কুলে যাবার রাস্তাটা যখন বড় রাস্তায় পড়েছে সেখানে গাড়ির ভিড় লেগেই থাকে। যেখানে গাড়ির ভিড় সেখানেই ফেরিওয়ালার ভিড় আর ভিখিরির ভিড়। ভিখিরিদের দেখতে টুনির খুবই মজা লাগে, যখন তারা কারো কাছে হাত পেতে কিছু চায় তখন তাদের চেহারা হয় খুবই কাঁচুমাচু কিন্তু যখন নিজেরা নিজেরা থাকে তখন তারা খুবই হাসি-খুশি। ভিক্ষা করার ব্যবসাটা মনে হয় খুবই লাভের ব্যবসা।