স্কুটার থেকে নেমে দাদি একটা বাসার সামনে দাঁড়ালেন; খানিকক্ষণ বাসাটার আশেপাশে তাকালেন, তারপর বললেন, “এই বাসাটাই হবে।”
“তুমি সিওর না?”
“মোটামুটি সিওর। অনেক দিন পরে এসেছি তো, তাই প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে।”
বাসার দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এটি ঠিক বাসা নয়, পাশের বাসাটি ঠিক বাসা। কাজেই তারা পাশের বাসায় গেল। পাশের বাসায় আবার কঠিন নিরাপত্তা, কার কাছে যাবে জিজ্ঞেস করে ফোন করে পারমিশান নিয়ে তারপর উপরে ওঠার অনুমতি পাওয়া গেল।
লিফটে তিনতলায় উঠে দেখা গেল দরজা খুলে মারিয়া দাদির জন্যে অপেক্ষা করছে। দাদি লিফট থেকে বের হবার সাথে সাথে মারিয়া দাদিকে জড়িয়ে ধরল, তারপর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। সাথে যে টুনিও আছে সেটা মনে হয় দেখতেই পেল না।
ভিতরে ঢুকেই টুনি বুঝতে পারল এরা অনেক বড়লোক। দাদির আত্মীয় স্বজন বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত টাইপ। কেউ বেশি মধ্যবিত্ত কেউ কম মধ্যবিত্ত। এরা মোটেও মধ্যবিত্ত না, এরা যথেষ্ট বড়লোক। বড়লোকের বাসায় সবকিছু সাজানো-গোছানো থাকে, তাই সেখানে খুব সাবধানে থাকতে হয়। টাইলস দেয়া মেঝে থাকে, তাই জুতো খুলে ঢুকতে হয়, ঘরের চারপাশে নানা রকম শোকেস থাকে, সেখানে নানা রকম বিদেশি পুতুল থাকে। ঘরের দেওয়ালে দেখে কিছু বোঝা যায় না-এ রকম তেলরঙের ছবি থাকে। সোফার সামনে কফি টেবিলে বিদেশি ইংরেজি ম্যাগাজিন থাকে। মধ্যবিত্তের বসার ঘরেই টেলিভিশন থাকে, বড়লোকের টেলিভিশন থাকে ভিতরে। কাজেই বসার ঘরে কোনো টেলিভিশন নাই, টুনিকে পুরো সময়টা বসে বসে টেলিভিশন দেখতে হবে না। দাদির সাথে আলাপ-আলোচনা আরেকটু জমে ওঠার পর সে তার গল্পের বইটা খুলতে পারবে। এখনই গল্পের বইটা খুলে পড়া শুরু করা মনে হয় একটু বেয়াদপি হয়ে যাবে। টুনি ধৈর্য ধরে গল্পগুজব জমে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
দাদির খালাতো বোনের মেয়ে মারিয়া দাদির সাথে নানা ধরনের গল্প গুজব করছে। কথা বলার স্টাইলটা বড়লোকের কথা বলার স্টাইল, মেপে মেপে সুন্দর করে কথা বলা। টুনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে। বড়লোকেরা তাদের টাকা-পয়সার গল্প করতে ভালোবাসে কিন্তু সেই গল্পটি করে খুব কায়দা করে। যেমন-মারিয়া বলল, “বুঝলে খালা, তোমার জামাইয়ের কোনো বাস্তব বুদ্ধি নাই। সংসারে আমরা মাত্র তিনজন, কোথায় ছোট একটা গাড়ি কিনবে, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাসের মতো ঢাউস একটা গাড়ি কিনে ফেলল।”
দাদি বললেন, “বড় গাড়িই তো ভালো, সবাই হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসতে পারবে।”
“সেইটা অবশ্যি তুমি ঠিকই বলেছ খালা। গত মাসে শ্রীমঙ্গলের একটা রিসোর্টে গেলাম, জার্নিটা টেরই পেলাম না। বুবাই পর্যন্ত কোনো কমপ্লেইন করল না।”
“তোমার ছেলের নাম বুঝি বুবাই?”
“হ্যাঁ খালা। ভালো নাম আদনাফ আবেদীন। এমনিতে বুবাই ডাকি।”
দাদি বললেন, “যখন জন্ম হয়েছিল তখন হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। এখন নিশ্চয়ই বড় হয়েছে।”
“হ্যাঁ খালা, বড় হয়েছে। সামনের মাসে এক বছর হবে।”
“তোমরা দুজনই কাজ করো, বাচ্চাকে দেখে কে?”
আলাপের এই পর্যায়ে মারিয়া গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “খালা, আমাদের কপাল খুব ভালো, বাচ্চা দেখার জন্যে খুব ভালো একটা বুয়া পেয়েছি। আমার কোনো চিন্তাই করতে হয় না। সে সব দেখে শুনে রাখে।”
দাদি একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন, “বাচ্চাকে সবসময় বুয়ার হাতে ছেড়ে দিও না। ছোট বাচ্চাদের কিন্তু মায়ের আদর খুব দরকার।”
মারিয়া বলল, “না, না, সবসময় বুয়ার হাতে ছাড়ি না। অফিস থেকে আসার পর তো আমার কাছেই থাকে।”
“দেখি তোমার বাচ্চাটাকে।”
মারিয়া তখন গলা উঁচিয়ে ডাকল, “মর্জিনা! মর্জিনা! বুবাইকে নিয়ে এসো।”
কিছুক্ষণের মাঝেই মর্জিনা বুবাই নামের বাচ্চাটাকে নিয়ে এলো। বাচ্চাটা ছটফটে। মারিয়া বুবাইয়ের দিকে হাত বাড়াল কিন্তু বুবাই তার মায়ের কাছে আসতে চাইল না, মর্জিনাকে আঁকড়ে ধরে রাখল। বোঝাই যাচ্ছে মায়ের চাইতে এখন মর্জিনাই বুবাইয়ের বেশি আপন।
মারিয়া একটু লজ্জা পেল, তাই উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় টেনে মর্জিনার কাছ থেকে বুবাইকে নিজের কোলে নিয়ে এলো।
দাদি বললেন, “দেও দেখি তোমার বাচ্চা আমার কাছে আসে কি না।”
দাদি হাত বাড়ালেন, বুবাই তখন দাদির কাছে চলে এলো।
টুনির ছোট বাচ্চা দেখতে খুব ভালো লাগে, সে উঠে এসে বুবাইয়ের সাথে একটা খেলা জমানোর চেষ্টা করল। খেলাটা খুব জমল না। বুবাই বড় মানুষের মতো টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার কাছে কিছু চাইছে। সেভাবে হাত পাতল।
ছোট বাচ্চা, বয়স এখনো এক বছর হয়নি। ভালো করে মনে হয় বসতেই শিখেনি কিন্তু হাত পেতে কিছু চাওয়া শিখে গেছে। কী আশ্চর্য!
টুনি বাচ্চাটির নাক স্পর্শ করল, গাল টিপে আদর করল, তারপর কোলে নেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু বুবাই যেতে রাজি হলো না। সে দাদির দিকে তাকাল তারপর দাদির দিকে হাত পাতল।
দাদি হেসে বললেন, “দাদু, আমার কাছে তুমি কী চাইছ? তোমাকে দেওয়ার মতো কিছু তো নাই!”
মনে হলো বাচ্চাটা দাদির কথা বুঝে গেল। সে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে মুখ দিয়ে উঁ উঁ শব্দ করে হাত পেতে চাইতেই থাকল।
দাদি বাচ্চাটার ভাবভঙ্গি দেখে হি হি করে হেসে ফেললেন। তারপর মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মারিয়া তোমার ছেলে এত বড় হয়ে গেছে, তাকে তো আমি কিছু দিলাম না।”