মানুষটা আবার ছুটে পালাতে গিয়ে তার গাউনে পা প্যাচিয়ে গেল এবং সে দড়াম করে একটা আলমারিতে ধাক্কা খেল। আলমারির কাঁচ ভাঙার শব্দের সাথে সাথে ঝনঝন করে কৌটা ক্রিম আর কাঁচের বোতল নিচে এসে পড়ল। মানুষটা কীভাবে জানি তার গাউনটা মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় হাঁচড়পাঁচড় করে সেটা খুলে ফেলল, নিচে একটা খাকি হাফ প্যান্ট। সেই অবস্থায় কোনোভাবে লাফ দিয়ে উঠে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে সে ছুটতে থাকে। পার্লারের কয়েকটা তেজি মেয়ে “ধর ধর” বলে চিৎকার করতে করতে তার পিছনে ছুটতে থাকে।
খালি গায়ে টাক-মাথার রোমশ একজন মানুষ খাকি একটা হাফ প্যান্ট পরে শপিং মলের ভিতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, যার মুখে ফেসিয়াল মাস্ক এবং ঠোঁটে লিপস্টিক এবং যার পিছনে কয়েকটা মেয়ে তাকে ধরার জন্যে ছুটে যাচ্ছে-এর থেকে বিচিত্র দৃশ্য আর কী হতে পারে?
.
ফারিহাপু যখন টুনিকে নিয়ে পার্লার থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল তখন পার্লারের যে কয়জন মহিলা এবং মেয়ে ছিল সবাই টুনির সাথে একটা করে সেলফি তুলল। শুধু তা-ই না, দুজনকে তার অটোগ্রাফ দিতে হলো। কাউন্টারে ফারিহাপুকে বিল দিতে হলো না, ম্যানেজার মহিলাটি বলল, “আপনার বিলটি আমরা দিয়ে দিচ্ছি।”
তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে ছোট ডিটেকটিভ, তোমার যেদিন বিয়ে হবে সেদিন আমাদের কাছে এসো, আমরা তোমাকে সাজিয়ে দেব। সব খরচ আমাদের।
টুনি ঠোঁট উল্টে বলল, “আমি কখনো বিয়ে করবই না!”
বুবাই কাহিনি
এই বাসায় সন্ধেবেলা নিয়ম করে সবাইকে পড়তে বসতে হয়। পড়ক আর নাই পড়ক সবাইকে পড়ার টেবিলে বসে থাকতে হয়। আজকেও সবাই বসেছে এই মুহূর্তে শুধু শান্তকে দেখা যাচ্ছে না। এটি অবশ্যি নূতন কিছু নয়, পড়ার টেবিলে শান্তকে মাঝে মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় না।
যারা পড়তে বসেছে তাদেরও যে পড়াশোনায় খুব মনোযোগ আছে, সেটা বলা যাবে না। টুনি অনেক কষ্ট করে একটা অংক শেষ করেছে, আরেকটা শুরু করবে কি না চিন্তা করছিল, তখন শান্ত এসে হাজির হলো। সে গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো করে বলল, “দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত! দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত!”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কেন শান্ত ভাইয়া? দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত কেন?”
“দাদি সেজেগুঁজে সিঁড়ি দিয়ে নামছে।”
দাদি সেজেগুঁজে নিচে নেমে আসা এই বাসার বাচ্চাকাচ্চাদের জন্যে আসলেই একধরনের বিপদ সংকেত। দাদি (কিংবা নানি) তাঁর সব আত্মীয় স্বজন, এমনকি আত্মীয়-স্বজনের আত্মীয়-স্বজন এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজনেরও খোঁজখবর রাখেন। মাঝে মাঝেই দাদি সেই সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে যান। দাদি কখনোই একা যান না, তাঁর অনেক নাতি-নাতনির কোনো একজনকে ধরে নিয়ে যান। নাতি-নাতনিরা সাধারণত এই আত্মীয় স্বজনদের চিনে না, তাই কেউই দাদির সাথে যেতে চায় না। নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে খসে পড়ার চেষ্টা করে।
শান্তর বিপদ সংকেতে কোনো ভুল নেই। সত্যি সত্যি দাদি (কিংবা নানি) তাদের পড়ার ঘরে এসে হাজির হলেন। সত্যি সত্যি দাদি সেজেগুঁজে এসেছেন। দাদির বয়স যখন কম ছিল, তখন নিশ্চয়ই খুবই সুন্দরী ছিলেন, এখনো দেখলে বোঝা যায়। টুম্পা বলল, “দাদি তোমাকে খুবই সুইট লাগছে, শুধু ঠোঁটে একটু লিপস্টিক দিলে–”
দাদি বললেন, “তারপরে বলবি চোখে কাজল, মুখে পাউডার, চুলে কলপ–”
টুনি বলল, “না, দাদি আমরা কিছু বলব না। তুমি যে রকম আছ সে রকমই ভালো।”
দাদি বললেন, “আমি মারিয়ার বাসায় যাব। তোরা কে যাবি আমার সাথে আয়।”
তখন সবাই যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল, কেউ আস্তে কেউ জোরে। প্রমি বলল, “দাদি, তোমার সাথে যাওয়া হচ্ছে যন্ত্রণা। তোমার মারিয়া না ফারিয়ারা বসে শুধু ঘ্যানঘ্যান করে, হাজবেন্ডকে নিয়ে একশ’ রকম নালিশ করে আর আমাদের বসে বসে সব শুনতে হয়!”
টুম্পা বলল, “জোর করে হালুয়া খাওয়ায়। কী পচা হালুয়া!”
শান্ত বলল, “লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞেস করে। কত বড় সাহস! আমি লেখাপড়া করি আর না করি তাতে তাদের এত সমস্যা কী?”
দাদি বললেন, “আমি এত কিছু শুনতে চাই না। কে যাবি আমার সাথে।”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে, লটারি করি। লটারিতে যার নাম উঠবে সে যাবে।”
তখন টুনি উঠে দাঁড়াল, “থাক শান্ত ভাইয়া, তোমার লটারি করতে হবে না। তোমার লটারি আমার জানা আছে, নিজের নাম না লিখে অন্য সবার নাম লিখে রাখবে।” তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো দাদি। আমি যাব তোমার সাথে।”
অন্য সবাই তখন আনন্দের মতো শব্দ করল।
.
টুনি তার ফ্রকটা পাল্টে নিয়ে একটা বই নিয়ে নিল। এখানে বসে বসে অংক করার থেকে মারিয়াদের বাসায় বসে গল্পের বই পড়া খারাপ কিছু না।
দাদি অনেক দরদাম করে একটা স্কুটার ঠিক করলেন। দরদাম করার মাঝে দাদি অনেক বড় এক্সপার্ট, কোনো কিছুই দরদাম না করে নেন না। স্কুটারে উঠে টুনি জিজ্ঞেস করল, “দাদি মারিয়াটা কে?”
“ওমা! মারিয়াকে চিনিস না? আমার যে খালাতো বোন আছে জোবেদা, তার ছোট মেয়ে।”
“তোমার আপন খালাতে বোন?”
“আপনের মতোই। মায়ের বান্ধবী।”
টুনি চুপ করে গেল, দাদির সব আত্মীয়-স্বজন এ রকম। লতায় পাতায়। তবে মজার ব্যাপার হলো, দাদি যখন কোনো খোঁজখবর না দিয়ে এ রকম হুট করে হাজির হয়, সবাই কিন্তু খুব খুশি হয়। এর কারণটা কী কে জানে।