“ওইটাই তো সমস্যা। যাদের চেহারা ভালো তাদেরকে বলে সুন্দরী। আর যাদের চেহারা ফার্নিচারের মতো তাদেরকে ভদ্রতা করে বলে সুইট।”
টুনি হেসে ফেলল, বলল, “না, আমি মোটেও সে জন্যে বলিনি–”
ফারিহা টুনির কথা শেষ করতে দিল না, বলল, “আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছিলাম, চেহারা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি কী দেখেছি জানো?”
“কী?”
“যে মানুষটাকে আমার ভালো লাগে তার চেহারা যে রকমই হোক, তাকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। অর্থাৎ মানুষ ভালো হলেই তার চেহারা ভালো।”
টুনি মাথা নাড়ল। ফারিহাপু কথটা ঠিকই বলেছে। ফারিহাপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কিন্তু যেহেতু আমি মানুষটা তত ভালো না, তাই বিউটি পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করে আসি। অন্তত মুখের চামড়াটা জুতোর চামড়ার মতো থাকবে না।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “ফেসিয়াল কী?”
ফারিহাপু বলল, “ও, ফেসিয়াল কি তুমি জানো না?”
“নাহ।”
“মুখে একধরনের মাস্ক পরে বিশ-ত্রিশ মিনিট বসে থাকতে হয়। মুখের চামড়া পরিষ্কার হয়।”
ফারিহাপু চলে যেতে যেতে থেমে গিয়ে বলল, “তোমার এখন কোনো কাজ আছে?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, নাই।”
“তাহলে চলো আমার সাথে। বিউটি পার্লারের ভিতরে কী হয় নিজের চোখে দেখে আসবে। তারপর কোনো একটা ফার্স্টফুডের দোকানে কিছু খেয়ে নেব। তোমার আম্মুর কাছ থেকে পারমিশান নিয়ে আসো। যাও।”
.
কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল লাল একটা গাড়িতে ফারিহাপুর পাশে বসে টুনি যাচ্ছে। ফারিহাপু নিজে সিট বেল্ট পরেছে, টুনিকেও পরিয়েছে। ফারিহাপুর গাড়িতে সিট বেল্ট না পরে কেউ নাকি উঠতে পারবে না। এই সিট বেল্টটা কেমন জানি টুনির গলায় ফাঁসের মতো আটকে আছে, এ ছাড়া কোনো সমস্যা নাই।
টুনি আবিষ্কার করল ফারিহাপু খুব ভালো গাড়ি চালায়, ঢাকা শহরে ভিড়ের ভিতর দিয়ে এক রিকশার পাশ দিয়ে অন্য স্কুটারকে পিছনে ফেলে বাসকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি চালানো খুব সহজ কথা না। টুনি খুব বেশি গাড়িতে ওঠেনি কিন্তু যখনই কারো গাড়িতে উঠেছে মনে হয়েছে ড্রাইভার বুঝি কাউকে ধাক্কা লাগাবে, শেষ মুহূর্তে গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করে থামিয়েছে। ফারিহাপু সেটা করে না, কেমন যেন শান্তিমতো গাড়ি চালায়।
ফারিহাপু একটা শপিং মলের নিচে গাড়ি পার্ক করল, তারপর টুনিকে নিয়ে শপিং মলের উপরে উঠে গেল। ছয়তলায় একটা বিউটি পার্লার, দরজায় ইংরেজি এবং বাংলায় লেখা “পুরুষ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।” টুনি বেশ অবাক হলো, এ রকম জায়গা আছে সে জানত না। ফারিহাপুকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ফারিহাপু, এই সাইনটা দেখে পুরুষ মানুষ রাগ করে না?”
“করে নিশ্চয়ই। করলে করুক।”
ফারিহাপু দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল, ভিতরে এয়ারকন্ডিশন করা বেশ আরামের ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব। ফারিহাপু ঢুকতেই কম বয়সের ছোটখাটো একটা মেয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “আপা! এতদিন পরে আসলেন? আমাদেরকে ভুলে গেছেন?”
ফারিহাপু বলল, “না না, ভুলব কেন? বাচ্চা কেমন আছে?”
“বাচ্চার কথা বলবেন না। যত দিন যাচ্ছে তত বান্দরের বাচ্চার মতো হয়ে যাচ্ছে। এক সেকেন্ড শান্ত হয়ে বসে না।”
“গুড!” ফারিহাপু বলল, “ছোট বাচ্চা যদি শান্ত হয়ে ভ্যাবলার মতো বসে থাকে তাহলে কেমন করে হবে?”
মেয়েটি ফারিহাকে একটা কাউন্টারে নিয়ে গেল, সেখানে ফারিহাপু খানিকক্ষণ কথা বলল, তখন আরেকজন মেয়ে ফারিহাপুকে পাশের ঘরে নিয়ে এলো। সেখানে সারি সারি বিছানা, সেখানে নানা রকম মহিলা শুয়ে আছে। তাদের কারো কারো মুখে সাদা মাস্ক, শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলে চমকে উঠতে হয়, মনে হয় ছোট, বড়, মাঝারি অনেকগুলো ভূত শুয়ে আছে। তাদের দেখে টুনির হঠাৎ কেমন জানি হাসি উঠে গেল।
ফারিহাপু ভেতরে কোথায় গিয়ে একটা অদ্ভুত গাউন পরে এলো, তখন টুনি বুঝতে পারল কেন বাইরে বড় বড় করে লেখা “পুরুষের প্রবেশ নিষেধ”। ফারিহাপু বিছানায় মাথাটা একটু উঁচু করে শুয়ে পড়ল, তখন একজন মহিলা একটা বাটিতে করে আলু ভর্তার মতো কিছু একটা নিয়ে এসে তার মুখে লাগাতে শুরু করল। টুনি একটু অবাক হয়ে দেখল ফারিহাপু দেখতে দেখতে অন্য বিছানায় শুয়ে থাকা মহিলাদের মতো ভয়ংকর হয়ে গেল, দুটো চোখ আর নাকের গর্ত ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না, মনে হয় একটা ভূত শুয়ে আছে।
টুনি কাছে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে সবকিছু লক্ষ করছিল। ফারিহাপু বলল, “টুনি, তুমি ইচ্ছে করলে সোফায় গিয়ে বসতে পারো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।”
টুনি বলল, “একটু দেখি কীভাবে ফেসিয়াল করা হয়।”
যে মেয়েটি ফারিহাপুর মুখে আলু ভর্তার মতো জিনিসগুলো লাগাচ্ছিল সে হেসে বলল, “কেন? তুমি কি বিউটি পার্লার দেবে?”
টুনি কিছু বলার আগেই ফারিহাপু বলল, “না না, টুনি বিউটি পার্লার দেবে না, সে বড় হয়ে ডিটেকটিভ হবে। এখনই সে কত কেস সলভ করছে। আপনি জানেন? পত্রিকায় টুনির উপর আর্টিকেল পর্যন্ত বের হয়েছে।”
ফারিহাপুর কথা শুনে টুনি লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, “ইশ! ফারিহাপু তুমি কী যে বলো!”
ঠিক তখন ফারিহাপুর পাশের বিছানাটাতে মোটামুটি পাহাড়ের মতো বড় একজন মহিলা এসে ধপাস করে শুয়ে পড়ল। মহিলাটির চেহারায় কিছু একটা গোলমাল আছে, গোলমালটা কী টুনি ঠিক করে ধরতে পারল না। ঠোঁটের কটকটে লিপস্টিক নাকি মাথার উপর উঁচু করে রাখা চুল, নাকি থামের মতো বড় বড় হাত-পা কোনটা সমস্যা টুনি বুঝতে পারল না।