“আর কাকে! তোমার ছোটাচ্চুকে।”
“ছোটাচ্চুকে?” টুনি প্রথমে একটু অবাক হলো, তারপর ফিক করে একটুখানি হেসে ফেলল।
ফারিহাপু অবশ্যি মোটেও একটুখানি হাসল না, হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খেতে লাগল; বলল, “মানুষ জীবনেও এ রকম একটা ঘটনা শুনেছে? যার কোম্পানি তাকে সেখান থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছে? ঘটনাটা শুনে হাসিতে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু আমি তো আর তোমার ছোটাচ্চুর সামনে হাসতে পারি না। বেচারা তাহলে মনে কষ্ট পাবে।”
টুনি মাথা নাড়ল; বলল, “হ্যাঁ, ছোটাচ্চুর খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু আমরা খুব খুশি হয়েছি। কোম্পানি দেওয়ার পর ছোটাচ্চু আস্তে আস্তে অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিল!”
ফারিহাপু ষড়যন্ত্রীদের মতো এদিক-সেদিক তাকিলে গলা নামিয়ে বলল, “আমিও খুব খুশি হয়েছি, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে।”
“কী কারণে ফারিহাপু?”
“আমি ভাবতাম তোমার ছোটাচ্চু মানুষটা হচ্ছে একেবারে নরমসরম লুতুপুতু মানুষ। কিন্তু সে যে মারামারিও করতে পারে সেইটা আমি প্রথম আবিষ্কার করলাম।” ফারিহাপু আবার হি হি করে হাসতে লাগল, হাসতে হাসতে প্রায় তার চোখে পানি এসে গেল, কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, “শুধু কি মারামারি? মারামারি করে একেবারে হাজতবাস। চোর, ডাকাত, পকেটমারদের সাথে সহাবস্থান”-কথা শেষ করে ফারিহাপু আবার হি হি করে হাসতে থাকে।
ফারিহাপু হাসি থামিয়ে বলল, “যাও দেখি, তোমার ছোটাচ্চুকে খবর দাও, বলো আমি এসেছি।”
টুনি ভেতরে গিয়ে দেখল ছোটাচ্চুর ঘর ফাঁকা, সেখানে কেউ নেই। ঝুমু খালা খবর দিল ঘণ্টা খানেক আগে ছোটাচ্চু নাকি সেজেগুঁজে বের হয়ে গেছে। টুনি ফিরে এসে ফারিহাপুকে জানাল যে ছোটাচ্চু নেই। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি যে আসছ সেটা ছোটাচ্চু জানে না?”
ফারিহাপু মাথা নেড়ে বলল, “নাহ্! আমি তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম, সে জন্যে বলিনি। এই জীবনে যতবার কাউকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়েছি ততবার ধরা খেয়েছি।”
“কী নিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলে ফারিহাপু?”
“তোমাকে দেখাই।” বলে ফারিহাপু তার ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দেখাল, “এই দেখো।”
টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “ড্রাইভিং লাইসেন্স! তুমি গাড়ি চালাতে পারো?”
ফারিহাপু বুকে থাবা দিলে বলল, “অবশ্যই পারি! এমনি এমনি কি ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েছে নাকি! আর তোমাকে একটা জিনিস জানিয়ে রাখি।”
“কী জিনিস?”
“যে ঢাকা শহরে গাড়ি চালাতে পারে সে পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতে গাড়ি চালাতে পারে। কাজেই ধরে নাও এই ড্রাইভিং লাইসেন্সটা হচ্ছে সারা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় গাড়ি চালানোর লাইসেন্স!”
ফারিহাপু ড্রাইভিং লাইসেন্সটা ব্যাগের ভিতরে রাখতে রাখতে বলল, “সারপ্রাইজটা যেহেতু মাঠে মারা গিয়েছে, তাহলে একটু ফোন করে দেখি শাহরিয়ার সাহেব কোথায় আছেন।”
ফারিহাপু তার ফোন বের করে ছোটাচ্চুকে ফোন করল, ছোটাচ্চু নিশ্চয়ই ফারিহাপুর ফোন পেলে খুব উত্তেজিত হয়ে যায়, তাই জোরে জোরে কথা বলে। টুনি তাই ফোন না ধরেও ছোটাচ্চুর গলা শুনতে পেল, “আরে ফারিহা তুমি?”
“হ্যাঁ আমি।”
“তুমি কোত্থেকে?”
“তোমার বাসা থেকে। তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম, এসে নিজে সারপ্রাইজ খেলাম।”
“কী সারপ্রাইজ?”
“বলে দিলে কি সারপ্রাইজ থাকবে নাকি? তুমি কোথায়?”
“মুন্সীগঞ্জ।”
“মুন্সীগঞ্জ মুন্সীগঞ্জে কী করো?”
“আমার এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে এসেছি। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট করতে হচ্ছে।”
“কী রকম ক্রাইসিস?”
“বর শেরওয়ানি আর পাজামা পরে এসেছে। পাজামার ফিতা ছিঁড়ে গেছে।”
ফারিহাপু মাথা নাড়ল। বলল, “বিশাল ক্রাইসিস। ম্যানেজ করো। ঠিক আছে, তুমি ফিরে এসো তখন কথা হবে।”
ফোন শেষ করে ফারিহাপু টুনির দিকে তাকাল, বলল “আমার হাতে এখন কয়েক ঘণ্টা সময়। কী করি বলো তো?
টুনি বলল, তুমি গাড়ি চালাতে পারো, গাড়ি চালিয়ে শাঁই শাঁই করে কোথাও চলে যাও। বইয়ের দোকান, ছবির এক্সিবিশন, চিড়িয়াখানা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, কত কী আছে।”
“তুমি যে জায়গাগুলোর নাম বলেছ সেখানে একা একা যেয়ে কোনো আনন্দ নাই। একা একা যেতে হয় বোরিং জায়গায়। যে রকম বাজার করতে, না হলে ইলেকট্রিক বিল দিতে, না হলে বিউটি পার্লারে।”
টুনি অবাক হয়ে বলল, “বিউটি পার্লার? আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ের সময় মেয়েরা বিউটি পার্লারে সাজে।”
“বিয়ের সময় তো সাজেই, এমনিতেও যায়। বড়লোক মেয়েরা বিউটি পার্লারে গিয়ে একজন আরেকজনের সাথে শাড়ি-গয়নার গল্প করে, না হলে একজন আরেকজনের কুটনামি করে!”
“তুমি যাও?”
“মাঝে মাঝে যাই। যখন দেখি চুলগুলো ত্যানার মতো হয়ে গেছে, না হলে মুখের চামড়া কার্পেটের মতো খসখসে হয়ে গেছে, তখন যাই। বিউটি পার্লারে খুব স্মার্ট কয়টা মেয়ে আছে, তারা কীভাবে কীভাবে জানি ঠিক করে দেয়।”
ফারিহাপু তখন হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো পরীক্ষা করল, মুখে হাত বুলাল, তারপর ব্যাগ থেকে ছোট আয়না বের করে নানা অঙ্গভঙ্গি করে নিজের মুখ পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ্, আমার চেহারা আস্তে আস্তে ডাইনি বুড়ির মতো হয়ে যাচ্ছে।”
টুনি বলল, “কী বলছ ফারিহাপু! তোমার চেহারা খুবই সুইট!”