দাদি (কিংবা নানি) অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে সতেরো বারের মতো বললেন, “আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার ছেলে মারপিট করে জেলহাজতে গেছে। আমার ছেলে? যে ছেলেকে আমি পেটে ধবেছি, সে মানুষের সাথে মারপিট করে জেলহাজতে যায়?”
দাদি যেটাই বলে ঝুমু খালা সবসময়ই সেটা বলে, এই প্রথমবার তার ব্যতিক্রম দেখা গেল। সে গলা উঁচিয়ে বলল, “এইটা আপনি কী বলেন খালা? জেলহাজত কেন-দরকার হলে আপনার ছেলে কালাপানিতে যাবে কিন্তু চোর-ছ্যাচড়-বান্দরের বাচ্চাদের পিটায়া সাইজ করবে না?”
ঝুমু খালা তারপর ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইজান, আপনি এই বদমাইশের বাচ্চাকে আচ্ছামতন দুইটা দিছেন তো? ঘুষি মাইরা নাকের হাড্ডিটা ভাইঙা দিছেন তো?”
বড় চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, “ঝুমু। তুমি থামবে? কী সব কথা বলছ? ছিঃ।”
ঝুমু খালা থামার কোনো লক্ষণ দেখাল না, বলল, “আপনি কী বলেন বড় ভাইজান, আমি যে খালি ঘরে বইসা তড়পাচ্ছি, এইটা ওই বান্দরের বাচ্চার সাত পুরুষের ভাগ্য! ছোট ভাইজানরে সোজা-সরল মানুষ পাইয়া হাজতে দেয়-আমার সাথে তেড়িবেড়ি করতে আসত, আমি গিয়া খাবলা দিয়া চোখ দুইটা তুইলা আনতাম।”
বড় চাচা হাল ছেড়ে দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন কী অবস্থা?”
ছোটাচ্চু পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বড় চাচার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে আমার ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বের করে দিয়েছে।”
ঘরের সবাই চমকে উঠল! বড় চাচা বললেন, “কী বলছিস? তোকে তোর কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছে?”
ছোটাচ্চু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “এটা এখন আর আমার কোম্পানি না। ঐ পাজি মানুষটা আমাকে দিয়ে কী সব কাগজ সাইন করিয়ে নিয়েছিল, আমি বুঝি নাই-এখন অফিসিয়ালি আমি ডিটেকটিভ এজেন্সির কেউ না। সবকিছুর মালিক সরফরাজ কাফির কোম্পানি।”
বড় চাচা হুংকার দিয়ে বললেন, “এটা কী মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি যে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলবে?”
বড় চাচা খুবই শান্ত মানুষ, কেউ তাকে কোনোদিন গলা উঁচিয়ে কথা বলতে শুনে নাই। তাই হঠাৎ করে বড় চাচা যখন হুংকার দিলেন, তখন সবাই অবাক হয়ে বড় চাচার দিকে তাকিয়ে রইল। বড় চাচা কী বলছেন কেউ শুনছে না, কীভাবে বলছেন সেটাই সবাই দেখছে।
বড় চাচা হাত-পা নেড়ে বললেন, “আমার পরিচিত সুপ্রিমকোর্টের ল’য়ার আছে, আমি মামলা করে দেব।
ছোটাচ্চু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “না ভাইজান। আমার মামলা করার ইচ্ছা নাই। যা হবার হয়েছে-আমি এর মাঝে আর নাই।”
তারপর কাউকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে ছোটাচ্চু নিজের ঘরের দিকে হেঁটে যেতে থাকল। বড় মানুষ কেউ তার সাথে গেল না কিন্তু বাচ্চারা সবাই দলবেঁধে তার পিছু পিছু গেল।
ছোটাচ্চু তার ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়াল। টুনি নরম গলায় ডাকল, “ছোটাচ্চু”
ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কিছু বলবি?”
“তোমার কি মন খারাপ ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “এখন মনটা কাজ করছে না, থেমে আছে। তাই বুঝতে পারছি না। যখন মনটা কাজ করতে শুরু করবে তখন বুঝতে পারব।”
“তুমি মন খারাপ কোরো না ছোটাচ্চু।”
তখন সবাই একসাথে বলতে শুরু করল, “হ্যাঁ ছোটাচ্চু, মন খারাপ কোরো না। প্লিজ ছোটাচ্চু-প্লিজ। তুমি মন খারাপ করলে আমাদেরও মন। খারাপ হবে।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, মন খারাপ করব না।” একটু থেমে বলল, “আসলে তোরা ঠিকই অনুমান করেছিলি যে সরফরাজ মানুষটা বদ।”
একজন বলল, “বদের লাঠি।”
আরেকজন বলল, “পাজির পা ঝাড়া।” আরেকজন বলল, “খাটাসের বাচ্চা খাটাস।”
তখন সবাই মিলে সরফরাজ কাফিকে গালিগালাজ শুরু করল। সে কী গালিগালাজ! মনে হলো গালিগালাজের তাপে ঘরে বুঝি আগুন ধরে যাবে।
গালাগাল একটু কমে আসার পর টুনি আবার ছোটাচ্চুকে ডাকল, “ছোটাচ্চু।”
“বল।”
“তোমাকে একটা কথা বলি?”
“বল।”
“তোমাকে যদি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিটা ফিরিয়েও দেয় তুমি সেটা নিয়ো না।”
ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে বলল, “নিব না?”
“না।”
“কেন?”
“বড় অফিস নেওয়ার পর তুমি অন্য রকম হয়ে গেছ। তোমার সাথে আমাদের আর দেখা হয় না। মনে আছে আগে কত মজা হতো? সবসময় তুমি আমাদের সাথে থাকতে!”
অন্য সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “হা হা, তুমি আমাদের সাথে থাকতে আর আমাদের কত মজা হতো।”
একজন বলল, “মনে আছে একবার একটা ছাগলকে রং করে দিয়েছিলে?” আরেকজন বলল, “তারপর আমরা নাটক করলাম?”
আরেকজন বলল, “আর ওই যে একবার রাজাকার টাইপের নানা যখন এসেছিল তখন রাত্রে ভূতের ভয় দেখানো হলো।”
আরেকজন বলল, “তারপর একটা দেওয়াল পত্রিকা বের করলাম? ভৌতিক সংখ্যা?”
আরেকজন বলল, “শান্ত ভাইয়া যখন স্কুলে ঝামেলায় পড়ল তুমি গার্জিয়ান সেজে গিয়ে শান্ত ভাইয়াকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলে।”
আরেকজন বলল, “স্কুলের স্পোর্টসের দিন তুমি আমাকে ডাইনি বুড়ি সাজিয়ে দিলে মনে আছে?”
আরেকজন বলল, “আমার সায়েন্স ফেয়ারের প্রজেক্টের জন্যে তুমি সেঁক ধরে আনলে মনে আছে?”
আরেকজন বলল, “সায়েন্স টিচারকে সেই জোঁক কামড়ে ধরল, আর সায়েন্স টিচার চিৎকার করে সবকিছু উল্টাপাল্টা করে ফেলল?”
মুনিয়া তখন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এখন তুমি কিছু কোরো না।”