ঝুমু খালার বাক্যটা দ্বিতীয়বার বলা ঠিক হবে না ভেবে মুনিয়া চুপ করে গেল।
টুম্পা বলল, “আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি মানুষটা খারাপ।”
“কীভাবে পরীক্ষা করেছিস?”
ঝুমু খালার লবণ-চা পরীক্ষার কথা বললে ঝুমু খালা বিপদে পড়ে যেতে পারে বলে কেউ পরীক্ষার পদ্ধতিটা নিয়ে কথা বলল না। মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
ছোটাচ্চু বলল, “তোরা এখন বিদায় হ। আমার এই কাগজগুলো পড়তে হবে।”
সরফরাজ কাফি ছোটাচ্চুকে পড়ার জন্যে বান্ডিল বান্ডিল কাগজ দিয়ে গেছে; ছোটাচ্চু কাগজগুলো সবাইকে দেখাল। তারপর আঙুল দিয়ে দরজাটা দেখিয়ে দিল, ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট-সবাই যেন বের হয়ে যায়। বাচ্চাগুলো তখন একজন একজন করে বের হয়ে গেল। টুনি বের হলো সবার শেষে, কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।
আধা ঘণ্টা পর টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল ছোটাচ্চু কাগজের বান্ডিলের উপর মাথা রেখে মুখ হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। ছোট ছোট অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা বান্ডিল বান্ডিল কাগজ ছোটাচ্চুর পক্ষে পড়া সম্ভব না। ঠিক কী কারণ জানা নেই। টুনির ছোটাচ্চুর জন্যে একটু মায়া হলো।
পরদিন সকালে ছোটাচ্চু তার দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে গিয়ে দেখে রঞ্জনা কেমন যেন হতচকিত ভঙ্গিতে বসে আছে। ছোটাচ্চু বলল, “কী খবর রঞ্জনা?”
রঞ্জনা বলল, “না মানে ইয়ে–” কিন্তু বাক্যটা শেষ করল না, কেমন যেন ভ্যাবাচেকার ভঙ্গি করে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে তার ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। অফিসে তার বড় ডেস্কটার পিছনে তার গদি আঁটা চেয়ারে সরফরাজ কাফি বেশ আয়েশ করে বসে আছে। সামনে একটা ফাইল; সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ছোটাচ্চু যতটুকু বিরক্ত হলো অবাক হলো তার থেকে বেশি। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল, ধরে নিল সরফরাজ কাফি তাকে দেখে চেয়ারটা ছেড়ে দেবে।
সরফরাজ কাফি চেয়ার ছেড়ে ওঠার কোনো নিশানা দেখাল না, হাসি হাসি মুখে বলল, “এই যে শাহরিয়ার সাহেব। গুড মর্নিং!”
ছোটাচ্চু গুড মর্নিংয়ের উত্তর না দিয়ে বলল, “মানে-আপনি আমার চেয়ারে?”
সরফরাজ কাফি এমনভাবে ছোটাছুর দিকে তাকাল যে দেখে মনে হলো সে ছোটাচ্চুর কথা বুঝতে পারছে না। একটু অবাক হয়ে বলল, “আ আপনার চেয়ার?”
“হ্যাঁ। এইটা আমার অফিস। আমার ডেস্ক। আমার চেয়ার।”
সরফরাজ কাফির হাসি আরো বিস্তৃত হলো, ছোটাচ্চুকে সামনে বসার ইঙ্গিত করে বলল, “কিন্তু আমরা যে কাল রাতে কন্ট্রাক্ট করলাম? আপনি ফিল্ড লেভেলে কাজ করবেন, আমি ম্যানেজমেন্ট দেখব। আপনি যেহেতু ফিল্ডে কাজ করবেন, কোনো অফিসের দরকার নেই, আমি এই অফিসে বসব।”
ছোটাচ্চুর মুখটা হাঁ হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “ক-কন্ট্রাক্টে তাই লেখা ছিল?”
“হ্যাঁ। আপনাকে একটা কপি দিয়ে এসেছি, পড়েননি?”
ছোটাচ্চু তার পায়ে জোর পাচ্ছিল না, কোনোভাবে একটা চেয়ারে বসে বিড়বিড় করে বলল, “কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।”
সরফরাজ কাফি জোরে জোরে মাথা নাড়ল; বলল, “না, না, গোলমাল হবে কেন? আমি আর আপনি মিলেই তো সবকিছু ঠিক করেছি। এই যে আমি ফাইল নিয়ে বসেছি। ফাইলে লেখা দশটার সময় আপনার একটা অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে পুরান ঢাকায়। এখন বাজে সাড়ে নয়টা, এক্ষুনি বের হয়ে যান, তা না হলে সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না।” সরফরাজ কাফি তারপর গলা উঁচিয়ে ডাকল, “রঞ্জনা, শাহরিয়ার সাহেবকে একটা স্লিপ দাও। ফিরে আসার পর খরচের ভাউচার নিতে ভুলে যেও না।”
সরফরাজ কাফি আবার হাসি হাসি মুখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব, আপনাকে আরো একটা জিনিস বলি। এত দিন আপনি এই এজেন্সিটাকে যেভাবে খুশি সেভাবে চালিয়েছেন, এখন যেহেতু আমি দায়িত্ব নিয়েছি, এখন এটাকে যেভাবে খুশি সেভাবে চালানো যাবে না। একটা নিয়মের ভিতর আসতে হবে, শৃঙ্খলার ভিতর আসতে হবে। যেমন ধরেন, অফিসের টাইম হচ্ছে নয়টা, আপনি এসেছেন সাড়ে নয়টায়-ভবিষ্যতে এটা হতে পারবে না। তারপর ধরেন আপনার পোশাক-একটা টি-শার্ট পরে চলে এসেছেন, এটাও ঠিক হয় নাই। কমপক্ষে ফুল হাতা শার্ট আর টাই। এখন টাইয়ের ফ্যাশন হচ্ছে চওড়া; চিকন একটা টাই পরে চলে আসবেন না যেন–”
এ রকম সময় ছোটাচ্চু বিকট আঁ আঁ শব্দ করে সরফরাজ কাফির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথম ঘুষিটা লাগাতে পারল না, তবে দ্বিতীয়টা ঠিক ঠিক লাগল এবং সরফরাজ কাফি চেয়ারসহ পিছন দিকে পড়ে গেল। ছোটাচ্চু লাফ দিয়ে সরফরাজ কাফির বুকের উপর বসে তার টাইটা টেনে বলল, “তবে রে দুই নম্বুরির ছাওয়াল চাইর নম্বুরি–”
সরফরাজ কাফি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, “হেল্প! হেল্প!!”
চিৎকার শুনে রঞ্জনা এসে পিছন থেকে ছোটাচ্চুকে ধরে কোনোমতে টেনে সরিয়ে আনল।
.
রাত্রিবেলা বাসায় খুবই উত্তেজনা। অনেক দিন পর বাসায় এ রকম উত্তেজনা হয়েছে। ছোটাচ্চু একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে আছে। তার মোটামুটি বিধ্বস্ত চেহারা। বড় চাচা ঘরে পায়চারি করছেন, একটু আগে অনেক কষ্ট করে বড় চাচা ছোটাচ্চুকে হাজত থেকে ছুটিয়ে এনেছেন। ছোটাচ্চুর হাতে মার খেয়ে সরফরাজ কাফি তার কোম্পানিকে ফোন করেছে, কোম্পানি ফোন করেছে পুলিশকে। পুলিশ এসে ছোটাচ্চুকে ধরে হাজতে নিয়ে গেছে। বড় চাচার সাথে পুলিশের বড় অফিসারের পরিচয় আছে, তা হলে কী হতো কে জনে!