শান্ত ভিতরে গেল, তারপর সবাইকে খবর দিল সরফরাজ কাফি নামের মানুষটা তাদের বাসায় চলে এসেছে, বাইরের ঘরে সোফায় বসে আছে। ছোটাচ্চুর কাছ থেকে কীসের জানি সিগনেচার নেবে।
তখন সবাই ছুটে গেল মানুষটাকে দেখার জন্যে, বাইরের ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে টুম্পা ফিসফিস করে বলল, “মানুষটা ভালো না।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”
“দেখছ না স্যুট-টাই পরে আছে। গরমের মাঝে যারা স্যুট-টাই পরে থাকে, তারা মানুষ ভালো না।”
মুনিয়া বলল, “তাছাড়া মোছটাও ভালো না।”
“মোছ ভালো না মানে কী?”
“দেখছ না কত চিকন মোছ! চিকন মোছ মানেই সমস্যা।”
সবাই যখন ভিড় করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সরফরাজ কাফিকে দেখছে তখন ঝুমু খালা হেঁটে যাচ্ছিল, সবাইকে জানালার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, “কী দেখো তোমরা?”
টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে একটা লোক এসেছে। লোকটা ভালো না খারাপ সেটা দেখছি।”
ঝুমু খালা বলল, “মানুষের চেহারা দেখে ভালো-খারাপ বোঝা যায় না। ফিরেশতার মতোন চেহারা কিন্তু আসলে ইবলিশ-এইরকম মানুষ আছে। আবার ইবলিশের মতোন চেহারা কিন্তু আসলে ফিরেশতা-এইরকম মানুষও আছে। মানুষের ভালো-খারাপ বোঝার জন্য অন্য নিয়ম আছে।”
“সেইটা কী?”
“পান-পড়া। পানের উপর খাঁটি সরিষার তেল লাগায়া সেটার উপর তিনবার ফুক দিতে হয়। ফুক দেয়ার সময় বলতে হয় ভালায় ভালা, মন্দে কালা। তারপর সেই পানটা মানুষের কপালে ডলে দিতে হয়। মানুষটা ভালো হলে কিছু হবে না। মন্দ হলে কপাল থেকে কালা রং বের হবে। পানটা হবে কুচকুচা কালা”
শান্ত বলল, “এই টেকনিক খুব ডেঞ্জারাস। মানুষটা মনে হয় তার কপালে পান-পড়া ডলতে দিবে না।”
মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “সোজা নিয়ম নাই ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “আছে একটা সহজ উপায়।”
“কী?”
“চায়ের মাঝে চিনির বদলে লবণ দিয়া দিমু। যদি মানুষটা ভালো হয়, মগজের মাঝে দুই নম্বরি বুদ্ধি না থাকে, তাহলে চা মুখে দিয়েই বলবে, হায়, হায়, চায়ের মাঝে দেখি লবণ! আর মানুষটা যদি দুই নম্বর হয়, যদি বদমতলব থাকে তাহলে টু শব্দ না কইরা চা’টা খায়া ফেলব।”
“সত্যি?”
“সত্যি না তো মিথ্যা নাকি!”
“ঝুমু খালা, তাহলে তাড়াতাড়ি লবণ দেওয়া চা নিয়ে আসো। প্লিজ।”
“ঠিক আছে।”
ঝুমু খালা তখন চা আনতে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই চা আর সাথে গরম গরম ভাজা ডালপুরি নিয়ে ঝুমু খালা বসার ঘরে হাজির হলো। ছোটাচ্চুর সামনে চিনি দেওয়া চা, সরফরাজ কাফির সামনে লবণ দেয়া চা আর দুইজনের মাঝখানে ডালপুরির প্লেট রেখে ঝুমু খালা চলে এলো। তারপর ঝুমু খালাও অন্যদের সাথে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল এখন কী হয়।
ছোটাচ্চু কাগজপত্রে সাইন করছিল, ঝুমু খালার তৈরি স্পেশাল ডালপুরি দেখে কাগজপত্র সরিয়ে রেখে ডালপুরি খেতে শুরু করল। সরফরাজ কাফি
অর্ধেকটা ডালপুরি ভেঙে নিয়ে একটুখানি খেয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। সবাই দেখল কাপে চুমুক দিতেই তার মুখটা বিকৃত হয়ে ওঠে, কাপটা মুখ থেকে সরিয়ে অবাক হয়ে সে কিছুক্ষণ কাপের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটাচ্চু অবশ্য কিছুই লক্ষ করল না, গভীর মনোযোগ দিয়ে একটার পর একটা ডালপুরি খেয়ে যেতে লাগল। ডালপুরি ছোটাচ্চুর খুবই প্রিয়।
জানালার পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে সবাই তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে সরফরাজ কাফি এখন কী করে। প্রথমে মনে হলো বুঝি কাপটা নামিয়ে রাখবে। শেষ পর্যন্ত নামিয়ে রাখল না। একবার আড়চোখে ছোটাচ্চুকে দেখে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বিস্বাদ-লবণাক্ত চা খেতে লাগল।
ঝুমু খালা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হাতে কিল দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এই লোক দুই নম্বুরির ছাওয়াল চাইর নম্বুরি। মাথার মাঝে বদমতলব।
গে রগে বদমাইশি। এর থেকে একশ হাত দূরে থাকন দরকার।”
সরফরাজ কাফি কাজ শেষ করে যখন চলে যাচ্ছে ঝুমু খালা তখন ট্রেতে করে খালি কাপ-প্লেট তুলে আনতে আনতে জিজ্ঞেস করল, “চা-নাশতা ঠিক ছিল আঙ্কেল?”
সরফরাজ কাফি এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালো ছিল। খুব ভালো ছিল। থ্যাংকু।”
ঝুমু খালা বলল, “পরের বার যখন আসবেন তখন আরো ভালো চা নাশতা দিব।”
সরফরাজ কাফি কোনো কথা না বলে চোখ ছোট ছোট করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
ছোটাচ্চু তার নিজের ঘরে পৌঁছানোর আগেই সবগুলো বাচ্চা তার ঘরে হামলা করল।
একজন বলল, “ছোটাচ্চু কাজটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কোন কাজটা?”
“এই যে একজন দুই নম্বরি মানুষকে তোমার সাথে নিচ্ছ।”
ছোটাচ্চু রেগে বলল, “কী রকম বেয়াদপের মতো কথা বলছিস! একজন সম্মানী মানুষ নিজ থেকে আমাকে সাহায্য করার কথা বলছে আর তোরা ঘ্যানঘ্যান করছিস?”
“তুমি হচ্ছ আমাদের ছোটাচ্চু-তোমাকে আমরা কিছু বলতে পারব না?”
“পারবি না কেন? একশ’বার পারবি। কিন্তু বড়দের ব্যাপারে তোরা নাক গলাচ্ছিস কেন? তোরা এসবের কিছু বুঝিস না জানিস?”
প্রমি মুখ শক্ত করে বলল, “একটা জিনিস জানি আর বুঝি।”
“কী জিনিস?”
মুনিয়া বলল, “এই মানুষটা দুই নম্বুরির ছাওয়াল চাইর নষুরি।”
ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললি! কী বললি তুই?”