পাশেই বসে ঝুমু খালা দাদির পায়ে গরম তেল মাখিয়ে দিচ্ছিল। গরম তেলে কী দিয়েছে কে জানে, দাদির শরীর থেকে শিক কাবাবের মতো একধরনের গন্ধ বের হচ্ছে। দাদির হুংকারের পর সেও একটা হুংকার দিল, “তোমরা কি চিল্লাফাল্লা থামাবা নাকি জরিনি বেওয়ার পানি-পড়া নিয়া আসুম?”
বাচ্চারা চিৎকার থামিয়ে ঝুমু খালার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। জরিনি বেওয়ার নাম তারা আগেও ঝুমু খালার কাছে শুনেছে, তার নানা রকম রহস্যজনক কাজকর্মের কথাও শুনেছে, পানি-পড়া দিয়ে কী হয় সেটা এখনো শুনেনি, তাই একজন জিজ্ঞেস করল, “জরিনি বেওয়ার পানি-পড়া দিয়ে কী হবে?”
ঝুমু খালা বলল, “খালি তোমাদের শরীরে একটা ছিটা দিমু, ব্যস, কথা বন্ধ। নো চিল্লা নো ফাল্লা।”
“সত্যি?”
“সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? আমাগো গ্রামে দবির মিয়া হইল ডাকাইতের বাচ্চা ডাকাইত। মার্ডার কেসের আসামি, যখন কোর্টে মামলা উঠছে তখন হে জরিনি বেওয়ার এক শিশি পানি-পড়া নিয়া গেছে। জজ সাহেব ঠিক যখন রায় দিব তখন জজ সাহেবের দিকে পানি-পড়া ছিটায়ে দিছে! ব্যস, জজ সাহেবের জবান বন্ধ। দবির মিয়া বেকসুর খালাস।”
সবচেয়ে ছোটজন রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?
ঝুমু খালা বলল, “সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? আমাগো গ্রামে চলো, দবির মিয়ারে দেখামু। এখনো ডাকাইতের বাচ্চা ডাকাইত।”
আরেকজন বলল, “আমাকে এক শিশি পানি-পড়া এনে দেবে?”
ঝুমু খালা জানতে চাইল, “কী করবা?”
“আমাদের স্কুলে বিলকিস মিসের গায়ে ছিটা দিব।”
“কেন?”
“ক্লাসে বড় জ্বালায়। ক্যাটক্যাট করে খালি বকা দেয়।”
তখন সবাই একসাথে হই হই করে উঠল, “আমাকে এক শিশি আমাকে এক শিশি–”
শান্ত বলল, “আমাকে এক বালতি।”
সবাই ঘুরে শান্তর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “এক বালতি? এক বালতি দিয়ে কী করবে?”
শান্ত হাসি হাসি মুখে বলল, “বিজনেস! ছোট ছোট শিশিতে ভরে বিক্রি করব। এক শিশি একশ’ টাকা!”
শান্ত কীভাবে জরিনি বেওয়ার পানি-পড়া দিয়ে বিজনেস করবে সেটা শোনার আগেই সবাই দেখল ঘরে ছোট চাচা ঢুকছে। তার মুখ হাসি হাসি এবং হাতে একটা ব্যাগ।
সবাই হই হই করে উঠল, “ছোটাচ্চু, কী এনেছ? কী এনেছ?”
ছোটাচ্চুর মুখের হাসি আরো বড় হলো; বলল, “ফাটাফাটি জিনিস। এই দ্যাখ–” তারপর ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা মোটা বই বের করে আনল। চকোলেটের বাক্সের বদলে একটা বই, তাও সেটা ইংরেজিতে লেখা। দেখেই সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এবং একসাথে সবাই মিলে যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। ছোটাচ্চু সেটা খেয়াল করল বলে মনে হলো, বইটা উপরে তুলে বলল, “এই হচ্ছে সেই বই। মাদার অব অল বুকস।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “ইংরেজি বই?”
ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ।”
“তুমি ইংরেজি বই পড়বে?”
ছোটাচ্চু একটু রেগে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ, পড়ব। কোনো সমস্যা আছে?”
শান্ত বলল, “তুমি বাংলাই ভালো করে জানো না, ইংরেজি বই কেমন করে পড়বে?”
ছোটাচ্চু হুংকার দিল, “আমি বাংলা জানি না?”
শান্ত বলল, “মনে নাই, আমি গোসল করব না বললে তুমি বলো আমি গোসলাব–”
“বলি না। আমি কোনোদিন গোসলাব বলি না।”
“বলেছ। দাদি বলেছে।”
শান্ত তখন তার দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদি, মনে আছে তুমি বলেছিলে ছোটাচ্চু ছোট থাকতে বলত আমি গোসলাব, বলত না দাদি?”
দাদি তার সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত। শাশুড়ি এখন বাড়ির বউয়ের চুল ধরে টানাটানি করছে, শান্তর কথা শোনার সময় নাই, তাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলত।”
শান্ত রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে বলল, “দেখেছ?”
“ছোট থাকতে কে কী বলে তার ঠিক আছে?”
শান্ত গম্ভীর মুখে বলল, “কারো যদি সমস্যা থাকে সেটা ছোট থাকতেই বোঝা যায়।”
মুনিয়া হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, ছবি আছে বইয়ে?”
ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “ছবি? ছবি দিয়ে কী হবে?”
“ছবি নাই?”
“নামানে, এইটা তো পোলাপানের বই না যে ছবি থাকবে। এটা হচ্ছে কাজের বই।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ?”
“এই তো কীভাবে বিজনেস বড় করতে হয়। ম্যানেজমেন্ট এফিসিয়েন্ট করতে হয়। প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে হয়।”
একজন কানে হাত দিয়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ ছোটাচ্চু তুমি এই খারাপ খারাপ কথাগুলো বোলো না, শুনলে গা শিরশির করে।”
আরেকজন বলল, “ছোটাচ্চুর কথা শুনে লাভ নাই। চকোলেটের বাক্স আনলে একটা কথা ছিল। আয় খেলি।” বলে সবাই খেলায় ফিরে গেল।
ছোটাচ্চু বইটা উপরে তুলে ধরেছিল; এবারে মনমরা হয়ে বইটা নিচে নামিয়ে বলল, “তোদের হয়েছেটা কী? দিন-রাত খাই খাই করিস। চকোলেট না আনলে কথাই শুনতে চাস না।”
কেউ ছোটাচ্চুর এই কথাটাও শুনল বলে মনে হয় না, সবাই হইচই করে খেলতে থাকল। দাদি একটু পরে আবার হুংকার দিলেন, “এই তোরা থামবি? থামবি একটু?”
ছোটাচ্চু যখন তার ঘরে গিয়ে জুতো খুলে বিছানায় বসেছে তখন টুনি গিয়ে ঢুকল, ছোটাচ্চু তাকে একনজর দেখে বলল, “কী হলো, কিছু বলবি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না।”
“তাহলে?”
“তুমি যেটা বলতে চাইছিলে সেটা শুনতে এসেছি।”
ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি কিছু বলতে চাই নাই। তোদের মতো পোলাপানদের সাথে আমি কী বলব?”
টুনি মাথা নাড়ল; বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার মুখ দেখেই সবকিছু বোঝা যায়। আজকে কিছু একটা হয়েছে, সে জন্যে তুমি খুব উত্তেজিত। তুমি কিছু