টুনি খেয়ালই করল না সে হঠাৎ করে মিলাকে তুই করে বলতে শুরু করেছে।
মিলা ঠোঁট উল্টিয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলছিল। অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে বলল, “তুমিও নতুন পৃথিবীর মতো আমাকে অবিশ্বাস করছ?”
টুনি গলা উঁচিয়ে বলল, “শুধু আমি কেন, যে কেউ অবিশ্বাস করবে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা এ রকম কবিতা লিখে না, লিখতে পারে না।” টুনি নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে ছুঁয়ে বল যে তুই নিজে এই কবিতাটা লিখেছিস।”
“ছুঁয়ে বললে কী হয়?”
“তুই যদি মিথ্যা কথা বলিস তাহলে আমি দড়াম করে পড়ে মরে যাব।”
মিলা চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“একশ’বার সত্যি।”
মিলা টুনির হাত ছুঁয়ে বলল, “আমি নিজে লিখেছি। খোদার কসম।”
টুনি তখন তার পকেট থেকে একটা ছোট নোটবই এবং কলম বের করে মিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এখানে একটা অটোগ্রাফ দে।”
মিলা বলল, “অটোগ্রাফ কী?”
“অটোগ্রাফ হচ্ছে তোর সিগনেচার।”
“সিগনেচার? সিগনেচার কেমন করে দেয়?”
টুনি বলল, “নিজের নাম নিজে লেখাই হচ্ছে সিগনেচার। এখানে তোর নামটা লিখে দিলেই সেটা হবে তোর অটোগ্রাফ।”
মিলা নোটবই আর কলমটা হাতে নিয়ে বলল, “আমাকে কেন অটোগ্রাফ দিতে হবে?”
“তার কারণ তুই একদিন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কবি হবি। কে জানে শুধু বাংলাদেশের না, হয়তো সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবি হবি! তখন সব মানুষ তোর পিছনে ঘুরবে তোর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্যে। আমি তখন বলব কবি মেহজাবিন আরা মিলার প্রথম অটোগ্রাফটা আমার কাছে আছে!”
মিলা লজ্জা পেয়ে টুনিকে ছোট একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “যাও টুনি আপু।”
“কে জানে, তখন হয়তো তোর অটোগ্রাফটা অনেক টাকায় বিক্রি করা যাবে। আমি অবশ্যি এটা বিক্রি করব না, আমার কাছে রেখে দেব।”
মিলা লাজুক মুখে টুনিকে আরেকটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “যাও টুনি আপু, তুমি শুধু ঠাট্টা করো।”
টুনি মিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি ঠাট্টা-তামাশা করি?”
মিলা মাথা নাড়ল, “না। সবাই বলে তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি। সেই জন্যেই তো আমি তোমার কাছে এসেছি।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। এসেছিস, ভালো করেছিস। এখন কথা বন্ধ করে আগে একটা অটোগ্রাফ দে।”
মিলা লাজুক মুখে নোটবইটার উপর কলমটা রেখে বলল, “শুধু নাম লিখলেই হবে?”
“উঁহু, প্রথমে লেখ প্রিয় টুনি আপু, তারপর লেখ তোমার জন্যে অনেক ভালোবাসা, তার নিচে তোর নাম লিখে আজকের তারিখটা দে।”
মিলা টুনির কথামতো সবকিছু লিখে নোটবইটা টুনির কাছে ফেরত দিল, মেয়েটির হাতের লেখা ঝকঝক করছে। এত ছোট মেয়ের হাতের লেখা এত সুন্দর হতে পারে বিশ্বাস করা কঠিন।
মিলা এসেছিল খুব মন খারাপ করে, চোখের পানি টলটল করছিল, এখন তার মনটা যথেষ্ট ভালো হয়েছে, মুখে একটু হাসি ফুটেছে। সে টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “এখন আমি কী করব টুনি আপু?”
“নতুন পৃথিবীকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।” “কীভাবে শিক্ষা দিবে টুনি আপু?”
“সেটা চিন্তা করে বের করতে হবে। চিন্তা করলে একটা বুদ্ধি বের হয়ে যাবে।”
মিলা বলল, “আমি অনেক চিন্তা করেছি, কোনো বুদ্ধি বের হয় নাই। সেই জন্যে তোমার কাছে এসেছি।”
“তুই চিন্তা করে সময় নষ্ট করিস না। চিন্তা করাটা আমার আমার উপর ছেড়ে দে। তুই কবি মানুষ, বসে বসে ভোরের শিশির আর ক্ষীণ মিয়মাণ সূর্যের আলো নিয়ে কবিতা লিখতে থাক।”
মিলা বলল, “আমার এত মন খারাপ হয়েছিল যে আমি ঠিক করেছিলাম আর কোনোদিন কবিতা লিখব না।”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “সে কী! আমি অ্যাডভান্স তোর থেকে অটোগ্রাফ নিয়ে রাখলাম আর তুই কবিতা লিখবি না মানে?”
মিলার চোখ আবার ছলছল করতে থাকে। কোনোভাবে কান্না সামলে নিয়ে বলল, “যখন এই খারাপ চিঠিটা এসেছে আমি তখন সেটা আব্বুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম, আব্বু কি বলেছে জানো?”
“কী বলেছে?”
আব্বু বলেছে, ও আচ্ছা ভেরি গুড!”
“ও আচ্ছা ভেরি গুড? তাই বলেছে?”
“হ্যাঁ। আমি কী বলেছি আব্বু শুনেই নাই। ও আচ্ছা ভেরি গুড বলে আবার পত্রিকা পড়তে শুরু করেছে।”
টুনি বলল, “কাজটা ঠিক হয় নাই।”
মিলা বলল, “তারপর চিঠিটা আম্মুর কাছে নিয়ে গেছি।”
“তোর আম্মু কী বলেছে?”
“আম্মু বলেছে উচিত শিক্ষা হয়েছে। লেখাপড়া নাই দিন-রাত বসে বসে ঢং করে কবিতা লিখিস, এখন যদি এই ঢং বন্ধ হয়!”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “হায় হায়! তাই বলেছে?”
“হ্যাঁ। সবচেয়ে খারাপ কথা বলেছে আমার আপু।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোর আপু কী বলেছে?”
আপু বলেছে, “তুই আরেকজনের কবিতা নকল করে লিখবি আর তোকে মাথায় নিয়ে নাচবে? তোর লজ্জা করল না আরেকজনের কবিতা নকল করে মেরে দিতে? তুই ছোট বলে ছেড়ে দিয়েছে। বড় হলে তোকে নিশ্চয়ই ধরে জেলে দিয়ে দিত, দুই বছর জেলে বসে বসে টয়লেট পরিষ্কার করলে তুই সিধে হয়ে যেতি।”
টুনি হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না। তোর আপুর এ রকম কথা বলাটা একেবারে ঠিক হয় নাই। মিলা, তুই মন খারাপ করবি না। আমি আছি তোর সাথে। তুই যখন অনেক বড় কবি হবি তখন তোকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করবে, আপনাকে কবি হওয়ার জন্যে কে অনুপ্রেরণা দিয়েছে? তখন তুই মনে করে আমার নাম বলবি কিন্তু!”
মিলা লাজুক মুখে হাসল, হেসে বলল, “তোমার সাথে কথা বলে আমার মন সত্যিই ভালো হয়ে গেছে।”