ছাগলটা মোটেই যেতে চাচ্ছিল না, রীতিমতো মানুষ-ছাগলে টানাটানি। কিন্তু মানুষটা ছাগলটাকে রীতিমতো টেনেহিঁচড়ে নিতে থাকে।
টুনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, তার কিছু একটা সন্দেহ হলো। তারপরে প্রায় ছুটে মানুষটার কাছে গিয়ে বলল, “এই যে আঙ্কেল–”
মানুষটা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমারে বলো?”
“জি। এইটা আপনার ছাগল?”
মানুষটা বিরক্ত হয়ে বলল, “তা না হলে কার হবে?”
“কী সুন্দর ছাগল! বাহ!” বলে সে ছাগলটার পাশে বসে তার গায়ের উপর হাত বুলিয়ে হাতটা চোখের সামনে নিয়ে আসে। তার হাত কালো রং লেগে কালো হয়ে গেছে। সে নিচু হয়ে ছাগলটাকে এঁকে দাঁড়িয়ে নাক কুঁচকে বলল, “আঙ্কেল, আপনার ছাগলটার শরীরে জুতার কালির গন্ধ। মনে হচ্ছে জুতা যেইভাবে রং করে এই ছাগলটাকে সেভাবে রং করা হয়েছে।”
মানুষটাকে দেখে মনে হলো সে টুনির কথা বুঝতে পারছে না, মুখটা অর্ধেকটা খুলে সে টুনির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
টুনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আঙ্কেল, আপনার ঝোলাটা একটু দেখি, ভিতরে জুতার কালি আর ব্রাশ আছে কি না?”
টুনি এগিয়ে যেতেই মানুষটা নিজের ঝোলাটা শক্ত করে ধরে ফেলল, সে ভিতরে দেখতে দিবে না। কী হচ্ছে বুঝতে ঝর্ণার একটু সময় লাগল, এবারে সেও এগিয়ে এসে টুনির সাথে যোগ দিল, দুইজনে মিলে ঝোলাটা
ধরে ফেলল এবং এবারে রীতিমতো একটা টানাটানি শুরু হয়ে গেল। গ্রামের মেঠোপথ, মানুষজন নেই কিন্তু চেঁচামেচি শুনে বাড়ির ভেতর থেকে একজন-দুইজন মানুষ বের হয়ে আসে। মানুষটা হঠাৎ করে নিজের বিপদ বুঝতে পারল, তখন ঝোলাটা ছেড়ে দিয়ে উল্টো দিকে একটা দৌড় দিয়ে দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল!
আশেপাশের বাসা থেকে মানুষজন এগিয়ে আসে, এদের মাঝে শামসুদ্দিনও আছে। ঝর্ণা শামসুদ্দিনকে বলল, “চাচা, এই যে আপনার ছাগল!”
“আমার ছাগল! এইটা?”
“জি। এইটারে কালা রং করছে! রং কাঁচা, হাত দিলে রং উঠে আসছে। এই দেখেন”-বলে ঝর্ণা ছাগলের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখাল রং উঠে আসছে।
টুনি ততক্ষণে মানুষটার ঝোলাটার ভিতরে উঁকি দিয়েছে, সত্যি সত্যি তার ভেতরে জুতার কালি, কালি দেওয়ার ব্রাশ, কিছু ময়লা কাপড় এবং একটা টাকার বান্ডিল পাওয়া গেল।
দেখতে দেখতে মানুষের ভিড় হয়ে গেল এবং কীভাবে ছাগল-চোর ধরা হয়েছে গল্পটা ডালপালা নিয়ে ছড়াতে শুরু করল। ঝর্ণাকে ঘটনাটা বর্ণনা করতে হচ্ছে এবং টুনি লক্ষ করল প্রত্যেকবারই ঘটনাটার মাঝে আরেকটু রং লাগানো হচ্ছে! চোরের সাথে হাতাহাতির একটা অংশ কীভাবে জানি ঢুকে গেল। চোরের চেহারার বর্ণনাটা রীতিমতো রোমহর্ষক।
টুনি ঝর্ণাকে ফিসফিস করে মনে করিয়ে দিল যে তাদের ঢাকা ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে, এখন তাদের বাড়ি যাওয়া দরকার।
.
বিকেলের দিকে টুনি ছোটাচ্চু আর ফারিহাপুর সাথে ঢাকা রওনা দিল। আগের রাত ফারিহাপু ঘুমায়নি, তাই সে দুপুরবেলা কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়েছে। ঝুমু খালা থেকে গেল। অনেক দিন তার বাড়িতে আসা হয়নি, এসেছে যখন কিছুদিন থেকে যাবে!
গাড়ি ছাড়ার পর ছোটাচ্চু বলল, “ফারিহা, আমি তোমার সাথে টানা কথাবার্তা বলে যাব, যেন তোমার ঘুম না পায়।”
ফারিহাপু মুখ টিপে হেসে বলল, “ঠিক আছে।”
ছোটাচ্চু টানা কথাবার্তা বলতে বলতে কিছুক্ষণের মাঝেই শিশুর মতো ঘুমিয়ে গেল। টুনি ছোটাচ্চুকে জাগিয়ে দিতে চাইছিল; ফারিহাপু বলল, “থাক, তুলে কাজ নেই। বেচারাকে ঘুমাতে দাও-তার চাইতে চললা তুমি আর আমি গল্প করি!”
টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “ঠিক আছে ফারিহাপু, কী নিয়ে গল্প করব?” “তোমার যেটা ইচ্ছা।”
টুনি কী যেন একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “ফারিহাপু, তুমি বলতে পারবে ছেলেদের যে ওয়াই ক্রোমোজম থাকে সেটার সাইজ এত ছোট কেন? এত ছোট একটা ক্রোমোজোম নিয়ে তারা থাকে, সে জন্যে তারা কি মেয়েদের সামনে লজ্জা পায় না?”
ফারিহাপু হেসে ফেলল, বলল, “সেটা তো জানি না। তোমার ছোটাচ্চু ঘুম থেকে উঠুক, তখন জিজ্ঞেস করতে হবে।”
তারপর দুজনেই ছোটাচ্চুর ঘুম থেকে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে!
ফিরে এলো ছোটাচ্চু
উৎসর্গ
হাসি-খুশি রেবেকা–
যেখানে থাকে, সেখানেই আনন্দ!
.
ভূমিকা
আমি যখন টুনটুনি ও ছোটাচ্চু নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম তখন একবারও ভাবিনি যে এদের নিয়ে দ্বিতীয় একটি বই লেখা হবে। এখন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করছি, শুধু দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় নয়, চতুর্থবারও লেখা হয়ে গেছে।
বলা বাহুল্য, আমার এই লেখালেখি করার কারণ হচ্ছে পাঠকদের চাপ। পাঠকেরা যদি কমবয়সী শিশু কিশোর হয়, তাদের চাপ অত্যন্ত কঠিন, সেখান থেকে বের হয়ে আসা সোজা কথা নয়! আরো লিখতে হবে কি না জানি না–যদি লিখেও ফেলি, সেই বইয়ের নাম কীভাবে দেব?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১১.১২.২০১৭
.
ফিরে এলো ছোটাচ্চু
দাদি (কিংবা নানি) বসে টেলিভিশনে একটা বাংলা সিরিয়াল দেখছেন, কাহিনি খুব জমে উঠেছে, শাশুড়ি বউকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে, ছেলে প্রতিবাদ না করে মুখ বন্ধ করে বসে আছে। সেই দৃশ্য দেখে দাদি অপদার্থ ছেলেটির উপর খুবই রেগে উঠছেন। কিন্তু তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন না কারণ খুব কাছেই বাচ্চারা হুটোপুটি করে খেলতে খেলতে চিৎকার করছে।
দাদি একটা হুংকার দিয়ে বললেন, “এই! তোরা থামবি? তোদের যন্ত্রণায় এক মিনিট টেলিভিশনটাও ঠিক করে দেখতে পারি না।”