“আল্লাহ দেখব।”
“তাবিজ-কবজ কে দিব?”
“ধুর বেকুব মেয়ে। তাবিজ কি আমি দেই নাকি? আল্লাহর কালাম পইড়া ফুঁ দেই। কখনো কামে লাগে কখনো লাগে না।”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা আপনার কথা অনেকবার বলেছে। আপনার পানি-পড়া দিয়ে নাকি মানুষের জবান বন্ধ করা যায়। পান-পড়া দিলে বিয়ে শাদি হয়!”
জরিনী বেওয়া টুনির কথা শুনে খিকখিক করে হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়। চোখ মুছে বলে, “তুমি ঝুমুর কথা বিশ্বাস করছ? হেই মেয়েটা হইছে আমার পাগলি মেয়ে। তোমারে আসল কথাটি কই, তুমি শুনো।”
টুনি বলল, “বলেন নানি।”
জরিনী বেওয়া ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা নামিয়ে বলল, “আসলে তাবিজ কবজ বলে কিছু নাই! যার মন দুর্বল হে আমার কাছে আসে, আমি আল্লাহর নামে ফুঁ দেই। তাবিজ চাইলে একটা তাবিজ দেই। দোয়া চাইলে মাথায় হাত দিয়া দোয়া দেই! দুর্বল মানুষ তখন মনে জোর পায়-নিজে নিজে কাম হয়-আর বলে জরিনী বেওয়ার তাবিজ!” কথা শেষ করে জরিনী বেওয়া আবার খিকখিক করে মাড়ি বের করে হাসতে থাকে।
টুনির মানুষটাকে খুব পছন্দ হলো। সবাইকে পানি-পড়া আর তাবিজ দোয়া দিচ্ছে কিন্তু নিজে কিছু বিশ্বাস করে না।
টুনি আর ঝর্ণা থাকতে থাকতেই একজন মাঝবয়সী মানুষ এসে জরিনী বেওয়ার সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে বলল, “নানি, বড় বিপদে পড়েছি!”
জরিনী বেওয়া বলল, “কে? তুমি কি শামসুদ্দি নাকি?”
“জি নানি।”
“তোমার বাপের শরীল ভালা?”
“জি নানি। আপনার দোয়া।”
“তা, তোমার সমস্যা কী?”
“নানি, আমার সাদা ছাগলডা খুঁইজা পাই না।”
“ছাগল খুঁইজা পাও না?”
“না, নানি।”
“শেয়াল ধইরা নেয় নাই তো?”
“না নানি, বড় ছাগল। শেয়াল নিব না।”
জরিনী বেওয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে কি মনে হয় চুরি গেইছে।”
“জি নানি।”
জরিনী বেওয়া একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “এই গ্রামে তো চুর-ডাকাইত আছিল না।”
“এখন মনে হয় আসতেছে।”
“তোমার কাউরে সন্দেহ হয়?”
“কিছু তো হয় কিন্তুক প্রমাণ নাই।”
ঠিক আছে, “ওই মটকা থেকে এক মুঠ চাউল আনো।”
মানুষটি বারান্দার এক পাশে রাখা মটকা থেকে এক মুঠি চাউল নিয়ে এলো। জরিনী বেওয়া চাউল ধরে রাখা মুঠিটি হাত দিয়ে ধরে বিড়বিড় করে কী যেন পড়ে ফুঁ দিল। তারপর বলল, “যারে সন্দেহ হয় তারে এই চাউল খেতে দিও। চুরি করলে চাবাইয়া চাউল নরম করতে পারব না। যাও।”
মানুষটি তখন তার গামছায় বাঁধা একটা মাঝারি লাউ বের করে জরিনী বেওয়ার পায়ের কাছে রেখে বলল, “নানি, গাছে লাউ ধরছে। ভাবলাম পয়লা লাউটা তোমারে দিয়া যাই।”
“আমার কি আর লাউ খাওনের সময় আছে। ঠিক আছে, আনছো যখন রাইখা যাও!”
মানুষটা চলে যাবার পর ঝর্ণা বলল, “নানি, তোমারে একটা জিনিস জিজ্ঞাসা করি?”
“করো।”
“যে চুরি করেছে সে আসলেই এই চাউল চিবাইতে পারব না?”
জরিনী বেওয়া কিছু বলার আগেই টুনি বলল, “না, পারবে না।”
“কেন?”
টুনি বলল, “তার কারণ যে চুরি করেছে তার মন দুর্বল। যখন শুনবে নানির চাউল পড়া তখন আরো ভয় পাবে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে যাবে, লালা বের হবে না। সেই জন্যে চাউল চিবাতে পারবে না!”
জরিনী বেওয়া একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি এইটা কেমন করে জানো?”
টুনি বলল, “আমি একটা বইয়ে পড়েছি!”
“বইয়ে এই সব লেখা থাকে?”
“জি নানি, অনেক কিছু লেখা থাকে। কিছু সত্যি, কিছু ভুলভাল, কিছু মিথ্যা!”
জরিনী বেওয়া বলল, “তাই তো বলি বইন, তোমার এত কম বয়সে চউখে চশমা কেন! বই পড়ে পড়ে চউখে চশমা! তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি বইন। খুব খুশি হইছি তোমারে দেইখা। বুদ্ধিরে শান দিও। বুদ্ধিরে শান দিলে বুদ্ধি বাড়ে।”
ঝর্ণা জিজ্ঞেস করল, “বুদ্ধিরে শান দেয় কীভাবে?”
“বুদ্ধির কাম করলেই বুদ্ধির শান দেওয়া হয়। খোদা বুদ্ধি দিছে মানুষরে, আর কাউরে দেও নাই।”
টুনি আরো কিছুক্ষণ বসে জরিনি বেওয়ার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তাদের আবার আজকেই ফিরে যেতে হবে, তাই সে উঠে পড়ল। জরিনী বেওয়া টুনি আর ঝর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিল। হেঁটে যেতে যেতে টুনি একবার পিছন ফিরে দেখল, জরিনী বেওয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা হামান দিস্তায় পান ভেঁচছে। যাদের দাঁত নেই তাদের পান খাওয়া একটা জটিল সমস্যা।
ঝর্ণার সাথে হেঁটে কিছু দূর যাওয়ার পর আবার শামসুদ্দিন নামের মানুষটার সাথে দেখা হলো। রাস্তার এক পাশে সে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। ঝর্ণা জিজ্ঞেস করল, “চাচা তুমি কী খোঁজ?”
“আমার মনে হলো আমার ছাগলের ডাক শুনলাম!”
সামনেই কুচকুচে কালো একটা ছাগল মনোযোগ দিয়ে একটা ছোট গাছের মাথা মুড়িয়ে খাচ্ছে, ঝর্ণা সেইটা দেখিয়ে বলল, “এইখানে ছাগল
তো এই একটাই!”
“কিন্তু এইটা কালো ছাগল! আমারটা সাদা।”
শামসুদ্দিন নামের ছাগল হারানো মানুষটা এদিক-সেদিক তাকিয়ে আরো কিছুক্ষণ তার সাদা ছাগলটা খুঁজল, না পেয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে হেঁটে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল।
ঠিক তখন খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখের একজন মানুষ কোথা থেকে যেন হাজির হলো, মানুষটার ভাবভঙ্গি কেমন যেন সন্দেহজনক। ময়লা কাপড়, ঘাড় থেকে ময়লা একটা ঝোলা ঝুলছে। সেখানে হাত দিয়ে একটা দড়ি বের করে কালো ছাগলটার গলায় দড়িটা বেঁধে ফেলল, তারপর ছাগলটাকে টেনে নিতে লাগল।