ছোটাচ্চু বলল, “কোনো ঝামেলা না। আসুক, আসার পর আমরা কথা বলব। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”
.
এদিকে বিয়ে বন্ধ করার উত্তেজনা শেষ হবার পর, চাউলের গুঁড়া দিয়ে তৈরি রুটি এবং মোরগের মাংস দিয়ে নাশতা করা হলো। (টুনি নিজের চোখে দেখতে পেল উঠানে ধাওয়া করে মোরগটিকে জহুরুল ধরে এনেছিল।) বড়রা যখন উঠানে বসে গ্রামের নানা ধরনের সমস্যা এবং তার সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করছে তখন টুনি ঝর্ণাকে ফিসফিস করে বলল, “ঝর্ণা আপু, তোমাদের গ্রামে জরিনী বেওয়া নামে একজন আছে না?”
ঝর্ণা অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ, আছে। তুমি তার নাম জানো কীভাবে?”
“ঝুমু খালা সবসময় তার গল্প করে।”
“ও!”
টুনি বলল, “আমাকে জরিনী বেওয়ার কাছে নিয়ে যাবে?”
“কেন?”
“এমনি! একটু দেখতে চাই মানুষটা কেমন।”
ঝর্ণা বলল, “ঠিক আছে, তাহলে এখনই চলে যাই।”
“কত দূর?”
ঝর্ণা হাসল, বলল, “ছোট গ্রামের ভিতরে সবকিছু কাছাকাছি। কোনোটাই দূরে না।”
.
ঝর্ণা টুনিকে নিয়ে বের হলো। একটু আগে যে মেয়েটার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল এখন সে গ্রামে বেড়াতে বের হয়েছে, সেটা যথেষ্ট আলোচনার বিষয়। কাজেই তাকে একটু পরে পরে তার ব্যাখ্যা দিতে দিতে যেতে হলো। যেমন ঝুমু খালার বাড়ি থেকে বের হতেই একজন মহিলা ঝর্ণার পথ আটকাল, বলল, “হেই ঝর্ণা, তোর বিয়া নাকি ভাইঙ্গা গেছে।”
“জি চাচি! আপনাদের দোয়া।”
“এইটা কী রকম কথা?”
“সত্যি কথা। আমি লেখাপড়া করতে চাই চাচি। পাস করে চাকরি বাকরি নিমু। তারপর বিয়া।”
“জামাই পার্টি কী বলে? বরযাত্রী আহে নাই?”
“রওয়ানা দিছিল। মাগরার বাজারের কাছে আইসা থাইমা গেছে। আর আসার সাহস পায় নাই।”
“ভয়টা কীসের?”
“মনে হয় পুলিশের। আমার বিয়ার বয়স হয় নাই-বিয়া বেআইনি।”
মহিলা চোখ কপালে তুলে বলল, “পুলিশ আইছিল নাকি?”
“জি আইতাছে। ওসি সাহেব আর টি.এন.ও.।”
“সর্বনাশ! কাউরে ধইরা নিব নাকি?”
“জে না চাচি। শহর থেকে যারা আসছে তারা সামাল দিবে।” তারপর টুনিকে দেখিয়ে বলল, “এই যে এই মেয়ে, তার চাচা, চাচার বন্ধু-সবাই আমার বিয়া ঠেকাইতে আসছে।”
মহিলা তখন খুবই তীক্ষ্ণ চোখে টুনিকে পরীক্ষা করল, তারপর বলল, “কয়দিন থাকবা?”
“আজকেই চলে যাব।”
“আজকেই! আমাদের গেরামটা একটু দেইখা যাও।”
“সেই জনেই বের হয়েছি।”
“কোথায় যাও?”
ঝর্ণা বলল, “জরিনী বেওয়ার কাছে।”
মহিলা চোখ কপালে তুলে বলল, “জরিনী বেওয়া? সমস্যাটা কী?”
ঝর্ণা হাসল, বলল, “কোনো সমস্যা নাই। অনেক নাম শুনছে তাই দেখতে চাচ্ছে।”
“যাচ্ছ যখন জরিনী বেওয়ার একটা তাবিজ নিয়া যাইও। লেখাপড়ার তাবিজ, শক্ত তাবিজ। এই তাবিজ নিয়া পাস করে নাই সেই রকম কখনো ঘটে নাই।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “জি আচ্ছা।”
এই মহিলার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে দশ পা এগোয়নি, তার মাঝে আরেকজন মহিলা তার পথ আটকাল, বলল, “এই ঝর্ণা, তোর বিয়া নাকি ভাইঙ্গা গেছে?”
ঝর্ণা আবার দাঁত বের করে হেসে বলে, “জি চাচি, আপনাদের দোয়া!”
তারপর হুবহু আগের আলোচনা চলতে থাকে!
.
জরিনী বেওয়ার বাড়ি খুব দূরে নয়, কিন্তু ঝর্ণাকে পথে কথা বলতে বলতে আসতে হয়েছে বলে পৌঁছাতে বেশ সময় লাগল। জরিনী বেওয়ার ছোট একটা মাটির বাড়ি, দরজাটা এত ছোট যে দেখে মনে হয় বুঝি হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ঝর্ণা ডাকল, “নানি, বাড়ি আছ?”
ভেতর থেকে থুরথুরে একজন বুড়ির গলা শোনা গেল, “কেডা?”
“আমি ঝর্ণা।”
“কুন ঝর্ণা?”
“ঝুমুর ছোট বোন।”
“ও আচ্ছা। কী খবর?”
“একজন মেহমান আসছে, তোমার সাথে দেখা করতে চায়।”
“কী সমস্যা? বিয়া-শাদি? নাকি পরীক্ষা পাস?”
“এগুলো কিছু না, তোমার নাম শুনেছে, তাই তোমারে একবার দেখতে চায়।”
ভিতরে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর ছোট দরজা দিয়ে একেবারে থুরথুরে একজন বুড়ি লাঠিতে ভর দিয়ে বের হয়ে এলো। এত বুড়ি যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। মানুষের বয়স হলে চুল কমে যায়, জরিনী বুড়ির মাথা ভরা চুল এবং সেই চুল শণের মতো ধবধবে সাদা। সারা শরীরের চামড়া কুঞ্চিত, মুখে একটিও দাঁত নেই। এলোমেলোভাবে একটা সাদা শাড়ি পরে আছে।
লাঠি ঠকঠক করে বাইরে এসে বলল, “কেডা আমারে দেখতে চায়?”
টুনি বলল, “আমি।” টুনি অবাক হয়ে জরিনী বেওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে মনে মনে জরিনী বেওয়া যে রকম হবে ভেবেছিল হুবহু সে রকম। কথা বলার ধরনটা পর্যন্ত তার কল্পনার সাথে মিলে গেছে। জরিনী বেওয়া চোখ কুঁচকে টুনিকে দেখার চেষ্টা করে বলল, “কাছে আও বইন। আজকাল চোখে দেখি না, কানেও শুনি না। শীতের সময় গরম লাগে, গরমের সময় শীত। রাত্রে চোখে ঘুম আসে না, সারা রাত জাইগা বইসা থাকি।”
টুনি একটু কাছে এগিয়ে গেল, জরিনী বেওয়া টুনিকে দেখে বলল, “চউখে চশমা বইন, কারণটা কী?”
টুনি বলল, “জানি না নানি। ছোট থাকতেই চোখ খারাপ হয়ে গেছে।”
“মনে হয় লেখাপড়া বেশি করছ।” জরিনী বেওয়া তার ঘরের বারান্দায় একটা পিঁড়িতে বসে বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকে, “সংগ্রামের সময় তোর নানারে যখন পাঞ্জাবিরা মারছে তখন আমার বয়স ষাইট। এখন বয়স একশ’র উপরে-আর কত? আজরাইল আইসা জানটা কবচ করলে তো জীবনটা বাঁচে–”
ঝর্ণা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে পড়ল, “কী বলো নানি! তুমি এখনই মরার কথা চিন্তা করো কেন? তুমি এই গ্রামের মুরুব্বি, তুমি না থাকলে আমাগো কে দেখে-শুনে রাখবে?”