নাইনের মেয়েরে বিয়া করার জন্যে পাগল হইত না। হাজার হলেও কাজটা বেআইনি। মেয়েদের বিয়ার বয়স আঠারো। ঝর্ণার বয়স মাত্র পনেরো–”
“এইগুলি কে জানে? কে দেখে?”
“জানাইলেই জানে। দেখাইলেই দেখে।” বলে ঝুমু ধারালো দা’টা বিপজ্জনকভাবে ধরে রেখে মুখটা হাসি হাসি করল।
বড় চাচা চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তুমি হাসো কেন?”
“এমনিই হাসি।” তারপর হঠাৎ করে মুখটা গম্ভীর করে বলল, “চাচাজি, এই বিয়েতে আমার মত নাই। এই বিয়া বন্ধ করেন।”
“তুমি মত দেওয়ার কে? তুমি মেয়ে মানুষ–”
ঝুমু খালা মুখ শক্ত করে বলল, “চাচাজি, মায়েরে জিজ্ঞাসা করেন মাসে মাসে কে টাকা পাঠায়। সংসার কার টাকায় চলে। এই বাড়িতে মত কে দিতে পারে একবার জিজ্ঞাসা করেন।”
বড় চাচা ধমক দিয়ে বললেন, “বড় বড় কথা বলবা না। বরযাত্রী রওনা দিচ্ছে, দুপুরে পৌঁছে যাবে।”
“আসতে না করেন। বেআইনি বিয়া, পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে বেইজ্জতি হবে। আপনার বেইজ্জতি, নূতন জামাইয়ে বেইজ্জতি।”
বড় চাচা হাসির মতো শব্দ করল, বলল, “তোমার কথায় পুলিশ আসব?”
“জে না। আমার কথায় পুলিশ আসব না। আমি কে? কিন্তু আমি যেই বাড়িতে থাকি সেই বাড়ির মানুষজনের কথায় পুলিশ আসব। পুলিশের বাবাও আসব। যদি বিশ্বাস না করেন, অপেক্ষা করেন। নিজের চোখে দেখবেন।”
ঠিক তখন একটা ছোট ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল, “একটা লাল রঙের গাড়ি আসতাছে। লাল রঙের গাড়ি!”
বড় চাচা চমকে উঠল, বলল, “গাড়ি কোথায় আসে?”
ঝুমু উত্তর দিল, “এই বাড়িতে।”
“কেন?”
“আসলে পরে আপনি জিজ্ঞেস করেন।”
যারা আশেপাশে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের একজন ভীত গলায় বলল, “মনে হয় পুলিশ।”
আরেকজন বলল, “না, পুলিশ না। মনে হয় টি.এন.ও. সাহেব।”
এই প্রথমবার বড় চাচাকে বিচলিত হতে দেখা গেল, দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, “কাজটা ঠিক হইল না।”
“চাচাজি, বেয়াদপি দিয়েন না, কাজটা কিন্তু আসলে ঠিকই হইছে। ঝর্ণা লেখাপড়া শেষ করব, চাকরি করব। তারপর বিয়া করব।”
“ভাত খাওয়ার পয়সা নাই। লেখাপড়ার শখ–”
“ভাত খাওয়ার পয়সা নাই কথাটা ঠিক না। বাপ মরে গেছে বলে আপনারা আমারে লেখাপড়া করতে দেন নাই। এখন আমি রোজগার করি, আমি ঝর্ণারে লেখাপড়া করামু। খোদার কসম।”
বড় চাচা বিষদৃষ্টিতে ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তারপর মেঘস্বরে বলল, “বরযাত্রী আইসা যখন দেখব এই অবস্থা তখন কী হবে?”
“একটা ফোন দেন। দিয়া বলেন যেন না আসে। দরকার হইলে আমার কথা বলেন-বলেন যে আমার মাথা আউলাঝাউলা। আমি দা নিয়ে ঘুরতাছি।”
অনেকেই গোল হয়ে ঘিরে কথাবার্তা শুনছিল, হঠাৎ একটা ছোট মেয়ে রিনরিনে গলায় বলল, “ঝর্ণা বুবুর সাথে বিয়া না হলে ঝুমু বুবু তুমি বিয়ে করে ফেলো!”
কথাটা বুঝতে ঝুমুর একটু সময় লাগল, যখন বুঝতে পারল তখন হি হি করে হাসতে লাগল। ছোট মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, “বুবু, তুমি হাসো কেন? আমি কি কিছু অন্যায্য কথা কইছি?”
ঝুমু হাসি থামিয়ে বলল, “না, তুই মোটেও অন্যায্য কথা বলিসনি। কিন্তু আমারে বিয়ে করতে সাহস লাগে! এই রকম সাহস কার আছে?”
ছোট মেয়েটা বলল, “তুমি একটু চিল্লাফাল্লা করে বুবু, কিন্তু তোমার মনটা তো ভালা! তুমি রাজি হয়ে যাও।”
ঝুমু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, “শোন, তোরে বলে রাখি, কেউ আমারে বিয়া করতে চাইলেই আমি তারে বিয়া করুম না। আমারও তারে পছন্দ হইতে হবে। বুঝলি?”
“বুঝছি।”
“যখন তোর বিয়ার বয়স হইব, তখন তুইও এই কথাটা মনে রাখিস।”
“যাও!” বলে লজ্জা পেয়ে মেয়েটা পিছনে সরে গেল।
এ রকম সময় ছোটাচ্চু আর ফারিহাপু এসে উঠানে ঢুকল, একদল বাচ্চাকাচ্চা তাদেরকে ঘিরে হাঁটছে। একজন মেয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে
আসছে, এ রকম বিষয় তারা আগে কখনো দেখেনি!
উঠানের লোকজনের মাঝে একধরনের উত্তেজনা দেখা গেল, দৌড়াদৌড়ি করে দুইটা চেয়ার নিয়ে আসা হলো। গামছা দিয়ে মুছে সেই দুইটা চেয়ার উঠানের মাঝখানে রাখা হলো। ঝুমু খালার বড় চাচা বিনয়ে একেবারে গলে গিয়ে হাত কচলে বলল, “বসেন। বসেন। আপনারা কি টি.এন.ও. সাহেব আর ও.সি. সাহেব?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, আমরা টি.এন.ও. না, ও.সি.ও। আমরা ঝুমুকে নিয়ে এসেছি।”
ফারিহাপু বলল, “তবে আমি টি.এন.ও., লোকাল থানার ওসি, আর স্কুলের হেড মাস্টারের সাথে কথা বলেছি। তারা সবাই আসছেন।”
ছোটাচ্চু বলল, “টি.এন.ও. সাহেব একটু ব্যস্ত, কিন্তু আপনাদের বরযাত্রী আসার আগেই চলে আসবেন। আমাদের কথা দিয়েছেন।”
বড় চাচা হাত কচলে বললেন, “অনুগ্রহ করে যদি তাদের বলে দেন তাদের আসার কোনো দরকার নাই। আমরা নিজেরাই বিয়েটা বন্ধ করে ফেলছি!”
টুনি খুবই শান্তশিষ্ট মেয়ে, নিজের আনন্দ বা রাগ প্রকাশ করার জন্য কখনোই চিৎকার-চেঁচামেচি করে না। কিন্তু আজকে কী হলো কে জানে সে আনন্দে একটা চিৎকার দিল এবং সাথে সাথে অন্যান্য বাচ্চাকাচ্চারা তার সাথে চিৎকার করে উঠল। ঝুমু খালাও একটা চিৎকার দিল এবং চিৎকার দেওয়ার সময় তার হাতের ধারালো দা’টা মাথার উপর ঘোরাতে লাগল।
ছোটাচ্চু ভয় পেয়ে বললেন, “এই ঝুমু, তোমার হাতে দা কেন? সর্বনাশ! দা রেখে এসো।”
ঝুমু খালা দাঁত বের করে হেসে বলল, “ঠিক আছে ছোট ভাইজান, দা রেখে আসি।”
বড় চাচা হাত কচলে আবার বলল, “পুলিশকে কি অনুগ্রহ করে আবার একটু ফোন করবেন? বলেন যে আসার কোনো দরকার নাই। বুঝতেই পারছেন, পুলিশ মানেই একটা ঝামেলা!”